×

মুক্তচিন্তা

স্মৃতি-সত্তায় প্রাণোচ্ছল শেখ কামাল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২২, ১২:৩১ এএম

৫ আগস্ট শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান শেখ কামাল ১৯৪৯ সালে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাই গোপালগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু এবং ১ দিনের কারাবরণ করেন। ঢাকায় সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদানের জন্য পুনরায় তিনি একই বছর ৩১ ডিসেম্বর কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। বন্দি থাকেন ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ শেখ কামালের জন্মের সময় তিনি মুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ শেখ কামালের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকা শহরের বাসিন্দা। কামাল সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। তিনি লিখেছেন- ‘মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভালো করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু‘ কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরো বেশি ব্যথা লাগে।’ শেখ হাসিনা পিতাকে যতটা কাছে পেয়েছিলেন শেখ কামাল ততটা নন। এ কথা বঙ্গবন্ধুর লেখায় স্পষ্ট- ‘এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনে না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল। আব্বা মাকে ধমক দিলেন এবং কাঁদতে নিষেধ করলেন। আমি থানায় আসলাম, বাড়ির সকলে আমাদের গোপালগঞ্জের বাসায় উঠল। থানায় যেয়ে দেখি এক দারোগা সাহেব বদলি হয়ে গেছেন, তার বাড়িটা খালি আছে। আমাকে থাকবার অনুমতি দিল সেই বাড়িতে।’ কামাল যে বারবার বঙ্গবন্ধুকে শিশু মন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন তা আরো একাধিক জায়গায় লেখা রয়েছে। যেমন- ‘থানায় ফিরে এলাম এবং দারোগা সাহেবের বাড়িতেই আমার মালপত্র রাখা হলো। আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন। যে সময় পুলিশ গার্ড এসেছে ফরিদপুর থেকে তারাই আমাকে পাহারা দেবে এবং মামলা শেষ হলে নিয়ে যাবে। আব্বা, মা ও ছেলেমেয়েরা কয়েক ঘণ্টা রইল। কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধহয় ভাবত, এ লোকটা কে?’ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে বেগম মুজিবের অসামান্য ভূমিকা ছিল। জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিজের স্বামীকে কখনো নিরুৎসাহিত করেননি ফজিলাতুন্নেছা। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে পুরো পরিবারের কষ্ট ও ধৈর্য ধারণের চিত্র রয়েছে আত্মজীবনীতে। এখানেও শেখ হাসিনা ও কামালের কথা আছে- “রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হল উল্টা। আরো কাঁদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, ‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?’ পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হলো।” বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে উঠে এসেছে শিশু শেখ কামালের একটি অসাধারণ ঘটনা যা একদিকে মর্মন্তুদ ও রাজনীতিবিদদের পারিবারিক জীবনের জন্য বেদনাদায়ক। অংশটি এ রকম- “একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দুজনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুইশত বৎসর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলনও করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরো কতকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে।” ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ প্রবন্ধে শেখ হাসিনা এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেপ্তার হন। আমি তখন খুব ছোটো আর আমার ছোটো ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। সেই সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা-আব্বা বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটি বড়ো পুকুর আছে, যার পাশে বড়ো খেলার মাঠ। ঐ মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল-পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না। আজ ও নেই। আমাদের আব্বা বলে ডাকারও কেউ নেই। ঘাতকের বুলেট শুধু আব্বাকেই ছিনিয়ে নেয়নি, আমার মা, কামাল, জামাল, ছোট্ট রাসেলও রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি কামাল-জামালের নবপরিণীতা সুলতানা ও রোজী, যাদের হাতে মেহেদির রং বুকের রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেছে।… সেদিন কামাল আব্বাকে ডাকার অনুমতি চেয়েছিল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে আব্বার কাছে নিয়ে যাই, আব্বাকে ওর কথা বলি। আব্বা ওকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করেন।’ উল্লেখ্য, শেখ কামাল ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দীর্ঘদিন বন্দি থাকায় বেগম মুজিবকে সংসারের সব দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। নিজের সন্তানদের লেখাপড়া দেখভালের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর মামলার খোঁজখবরও নিতে হয়। এই পরিস্থিতিতে সন্তানদের বঙ্গবন্ধু ভালো করে লেখাপড়া করতে বলেছেন আর বেগম মুজিবের কথা মেনে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে- ‘রেণু বলল, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দিবে। দেখে খুশিই হলাম। ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাবভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে অনেকদিন আরো থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।’ বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনার স্মৃতিকথায় শেখ কামাল উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন একাধিক জায়গায়। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আগস্ট মাস। এই আগস্ট মাসে আমার মায়ের যেমন জন্ম হয়েছে; আবার কামাল, আমার ভাই, আমার থেকে মাত্র দুই বছরের ছোট, ওরও জন্ম এই আগস্ট মাসে। ৫ আগস্ট ওর জন্ম।’ অন্যত্র- ‘হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাত্রে ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চলে যায়। পিতার গ্রেপ্তার হবার সংবাদ পেয়ে কামাল কার্ফুর ভিতরেই গেরিলা কায়দায় ৫০টি বাড়ির দেয়াল টপকে সন্ধ্যায় মাকে দেখতে আসে।’ এরপর তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য ভারতে চলে যান। বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি ধানমন্ডির বাসায় ফিরে আসেন। শেখ কামাল ছিলেন উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত ও পরোপকারী ব্যক্তিত্বের পুরোধা। তিরিশ বছর (১৯৪৯-১৯৭৫) পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি এদেশের মানুষের কাছে আদর্শের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। যারা তার সান্নিধ্যে এসেছিলেন তারা অনুভব করেছেন তার স্নিগ্ধ ও হাস্যোজ্জ্বল মমত্ববোধ। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এই প্রাণোচ্ছল শেখ কামালের পরিচয়ই স্মৃতি-সত্তায় অমর করে রেখেছেন।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App