×

মুক্তচিন্তা

রেলক্রসিংগুলো নিরাপদ হবে কবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২২, ০১:৪৪ এএম

রেলক্রসিংগুলো নিরাপদ হবে কবে?
গত শুক্রবার হাটহাজারীর যুগীরহাটের ‘আর এন জে’ কোচিং সেন্টার থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে ৪ শিক্ষক ও ১২ ছাত্র মিলে মোট ১৬ জন একটি মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়ে মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণা পরিদর্শনে যান। ফেরার পথে দুপুর দেড়টায় পর্যটকদের গাড়িটিকে চট্টগ্রামমুখী আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতী ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলে চালকসহ ১১ জন মারা যান ও হেলফারসহ বাকি ৬ জন গুরুতর আহত হন। দুর্ঘটনায় ১১ ছাত্র-শিক্ষকের মর্মান্তিক মৃত্যু সারাদেশকে নাড়া দিয়েছে। রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় গাড়িচালক যদি মাত্র কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা কিংবা একটু সতর্ক হতেন এবং একই সঙ্গে গেটম্যানও তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতেন, তাহলে এভাবে ১১টি পরিবারের স্বপ্নের সমাধি হতো না। একসঙ্গে একই এলাকার এতগুলো তরুণের চলে যাওয়া যেন এলাকাবাসীর কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাত। যুগীরহাটের লোকজন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এ মৃত্যু। ছারখার হয়ে গেছে তাদের সুখের সংসার। এতে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় না, নিহত বা আহতদের সুচিকিৎসার জন্য কোনো অর্থকড়ির ব্যবস্থা বা ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না। জানা যায়, ক্ষতিপূরণ না দেয়ার পেছনে বড় কারণ হলো রেলওয়ের ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো আইনে রেললাইনে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণের কথা বলা নেই। রেলওয়ে আইন-১৮৯০ এর ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ট্রেনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে বা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড হবে। ট্রেন চলাচলের সময় কোনো যানবাহন বা মানুষ উঠে গেলে তা ট্রেন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হিসেবে ধরা হয়। ফলে রেললাইনে প্রাণহানি ঘটলে কোনো ক্ষতিপূরণ মিলে না। এ দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে দায়ী করছেন। তবে তদন্ত রিপোর্ট দেখে দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার একটা সুযোগ থাকলেও সে সুযোগ কোনোদিন আসে না। কারণ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কোনোদিন আলোর মুখ দেখে না। উক্ত দুর্ঘটনার জন্য গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে জিআরপি থানা পুলিশ ও অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩৩৮(ক)/৩০৪(ক)/৪২৭ ধারায় মামলা দায়ের করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষও গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে। রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয় তার ৮৯ শতাংশ ঘটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। বাস, মাইক্রোবাসসহ অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে এসব প্রাণহানি ঘটলেও ক্রসিংগুলো নিরাপদ করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকারে থাকে না। এ কারণে রেলক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। রেলের হিসাব মতে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৮৬৮টি রেল দুর্ঘটনার মধ্যে ৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে লেভেল ক্রসিংয়ে। যাতে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। তাদের সবাই ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী। উল্লেখ্য, এ হিসাবের মধ্যে রেলক্রসিং পারাপারে নিহত পথচারীদের সংখ্যা নেই। রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের ২৯ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশের রেলক্রসিংগুলোতে ১১৬টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছে। সংগঠনটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩৮ দুর্ঘটনায় ৬৯ জন, ২০২১ সালে ৪৩ দুর্ঘটনায় ৭৬ জন, ২০২২ সালের ২৯ জুলাই পর্যন্ত ৩৫ দুর্ঘটনায় ৭৪ জন মারা যান। এ ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক প্রকোশলী আবুল কালাম চৌধুরী গেটম্যানের পক্ষ নিয়ে যা বলুক না কেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুর্ঘটনার সময় গেটকিপার পাশের একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যান। তখন রেললাইনের গেটবার ফেলানো ছিল না। একই কথা চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নাজিম উদ্দিনও বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান ঘটনাস্থলে ছিলেন না। গেটবারও ফেলানো ছিল না। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের বক্তব্য ধোপে টিকে না। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এখানকার গেটম্যানরা প্রায়ই গেট খোলা রেখে বা বন্ধ করে চলে যায়। আবার অনেক সময় গেটম্যানকে উপেক্ষা করে অনেকে গেট খুলে জোর করে পার হতে চান। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলাসহ মাইক্রোবাসের চালককেও দায়ী করেছেন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সুদীপ কুমার পাল বলেন, ‘রেলক্রসিং পারাপারে জনসচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। নিজের জীবনের নিরাপত্তা আগে। সবাইকে চিন্তা করতে হবে, লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান থাকুক আর না থাকুক; পার হওয়ার আগে সিগন্যালটা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়; ট্রেন আসতে থাকায় ক্রসিংগুলোতে সিগন্যাল দেয়া হয়েছে বা গেটম্যান বার ফেলেছে; এরপরও অনেকে এসবকে তোয়াক্কা না করে তাড়াহুড়ো করে পার হচ্ছে; যা কোনোভাবে কাম্য নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ট্রেন চলে তার নিজস্ব গতিতে; তা তৎক্ষণাৎ থামানো সম্ভব নয়। তাই রেলক্রসিং পারাপারে সবাইকে সচেতন হওয়া জরুরি। পাশাপাশি জননিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সারাদেশে বিদ্যমান লেভেল ক্রসিংগুলোকে সামনে ওভারপাস বা আন্ডারপাসে রূপান্তর করা প্রয়োজন। এতে রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা অনেকাংশে কমে যাবে।’ রেল সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিংগুলোর পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন শীর্ষক দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। ৪ বছর মেয়াদে প্রকল্পের অধীনে পূর্বাঞ্চলে ৩২৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের মানোন্নয়ন ও ১,০৩৮ জন গেটকিপার নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৮১৭ জন নিয়োগ দেয়া হলেও অনিয়মিত বেতন-ভাতার কারণে নিয়োগপ্রাপ্তদের বড় একটি অংশই চাকরি ছেড়ে দেন। শুরুর দিকে এ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৪৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। প্রথম দফায় ২০১৯ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ায় দ্বিতীয়বার সংশোধিত এ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। তখন প্রকল্পের আকার ১০০ কোটি টাকা করা হয়। যদিও অস্থায়ী গেটম্যানের বেতন-ভাতা পরিশোধে এ প্রকল্পের দুই-তৃতীয়াংশ টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। কিন্তু রেল ক্রসিংয়ে তেমন কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তা সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। মূলত অস্থায়ী গেটম্যানদের বেতন-ভাতায় এসব অর্থ ব্যয় করা হয়। এর মধ্যে অস্থায়ী হওয়ায় অনেক গেটম্যান চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এতে সংকট তৈরি হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় স্থায়ী গেটকিপারও নিয়োগ হচ্ছে না। সবকিছু মিলে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। আশা করি, শিগগিরই নতুন নিয়োগের মাধ্যমে এই সংকট কেটে যাবে। সুতরাং মনেপ্রাণে কামনা করি, গেটকিপারজনিত সংকট কেটে যাক, রেলক্রসিংগুলো নিরাপদ হোক এবং চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ কুমার পালের পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করা হোক। গোপাল নাথ বাবুল লেখক, দোহাজারী, চট্টগ্রাম। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App