প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে দেশের অগ্রগতি হয়েছে। বিগত ১৬ বছরে প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নতির প্রমাণ তুলে ধরেছে একটি বেসরকারি সংস্থা। এতে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে ভর্তির হারের সঙ্গে বেড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শিক্ষায় লিঙ্গভিত্তিক সমতাও একরকম এসেছে। প্রতিবেদনে শিক্ষকদের যোগ্যতার প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৯৮ সালে যেখানে ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষকের ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি ছিল, ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই হার ৬৬ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন। ১৬ বছর আগে এই হার ছিল অর্ধেক, অর্থাৎ ৩২ শতাংশ।
উন্নয়নের অন্যতম সূচক হলো শিক্ষা। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারলে জাতি উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু তার জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ বিস্ময়কর গতিতে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ভর্তি-বিষয়ক লক্ষ্য অর্জন করলেও শিক্ষার মানোন্নয়নের কাজে সেই গতির সঞ্চার করা যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলা হয়, ‘সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য হাজার হাজার শ্রেণিকক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এর পরিবেশ শিশু শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগী নয়। প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের প্রয়োজন মেটাতে হলে শিক্ষকদের উপযুক্ত পরিচিতিমূলক ধারণা, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষক মূলত সহায়কের ভূমিকা নেবেন। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের চেহারাও খুব ভিন্নরকম হতে হবে যেখানে শিশু খেলতে খেলতে শিখবে। এক্ষেত্রেও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার মধ্য দিয়ে এবং পরস্পরের শক্তির জায়গাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমরা সব পর্যায়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারি।’ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজকে সম্পৃক্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। দারিদ্র্য বিমোচন, শিশুমৃত্যু হ্রাস, জন্মহার হ্রাসসহ অতীতের অনেক সফল উদ্যোগে সরকার ও সুশীল সমাজ একত্রে কাজ করার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘একত্রে কাজ করার মধ্য দিয়ে এমডিজি-পূর্ববর্তী ও এমডিজি সময়কালীন আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছি। এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সে ধরনের জোরদার সমন্বিত কর্মকাণ্ডে সুযোগ তৈরি করা সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
গত ৫০ বছরে দেশের শিক্ষায় সংখ্যার দিক দিয়ে অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইসের) সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস, ২০২০’-এ। এই প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৭ হাজার ৭৯১টি। এগুলোয় শিক্ষার্থী ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ। এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হয়েছে ২০ হাজার ৮৪৯টি। এগুলোয় শিক্ষার্থী হয়েছে ১ কোটির বেশি। এছাড়া দেশে আলিয়া ও দাখিল মাদ্রাসা আছে ৯,৩০৫টি। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ২৫ লাখের বেশি। বিদ্যালয় গমনোপযোগী শতভাগের কাছাকাছি শিক্ষার্থী এখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। বিপরীতে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশে। অথচ ২০০৫ সালেও প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৭ শতাংশের মতো। মাধ্যমিকেও ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এখন সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজারের বেশি, যার মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেছে। দেশে এখন প্রাথমিক স্তরে দুই কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়ে। এর মধ্যে ৫১ শতাংশই ছাত্রী। সরকারি বিদ্যালয়ে এই হার আরো বেশি। সংখ্যা বিচারে কলেজেও ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সমতা অর্জিত হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ছাত্রীরা সংখ্যায় পিছিয়ে। যদিও মেডিকেল শিক্ষায় আবার ছাত্রীরা এগিয়ে আছেন।
দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে অন্যতম বৃহৎ অর্জন কোটি কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ। বিশ্বের অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশও এই উদ্যোগ নিতে পারেনি। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব শিক্ষার্থীকে নতুন বই দেয়া শুরু হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি বই দেয়া হচ্ছে। গত ১২ বছরে একবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বই ছিল ঝুঁকির মুখে। তবুও সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে করোনার মধ্যেও চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় নতুন বই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মোট ১২ বছরে ৩৬৫ কোটি ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮১টি বিনামূল্যের বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বিনামূল্যের বই দেয়া হয়েছে। সরকার ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাঝে তাদের নিজেদের ভাষায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ শুরু করেছে। চাকমা, মারমা, সাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরা এই ৫ ভাষার শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরে তাদের মাতৃভাষায় বই ছাপানো হয়। এছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে ব্রেইল বই।
সুপ্রতিম বড়ুয়া
সহযোগী অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ, কক্সবাজার।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।