×

মুক্তচিন্তা

সত্তরের বিজয় এবং রক্তাক্ত আগস্ট

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৯ এএম

আগস্ট মাস এলেই আমার ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা মনে পড়ে। সত্তরের নির্বাচনে পঞ্চগড়ের ৫টি থানা নিয়ে জাতীয় পরিষদের একটি ও প্রাদেশিক পরিষদের দুটি করে আসন ছিল। জাতীয় পরিষদের এমএনএ পদে ও প্রাদেশিক পরিষদের এমএলএ পদে প্রাদেশিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রার্থী ছিলেন। এমএনএ পদে এডভোকেট গোলাম রহমান ও এমএলএ পদে প্রার্থী ছিলেন দ্বীপেন চন্দ্র রায়। ওই এলাকায় বামপন্থি রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তির দুর্বলতার জন্য আমাদের মনে হয়েছিল যে ন্যাপের প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ভোটের ফলাফল ঘোষণা করার পর ন্যাপের প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। ভোটের ব্যবধানও ছিল অনেক। নৌকার প্রবল স্রোত সব ভাসিয়ে নিয়েছিল। ‘ভেঙেচুরে কুঁড়েঘর- সবাই মিলে নৌকায় চড়’, বাস্তবে তাই হয়েছিল। অথচ কুঁড়েঘরের প্রার্থী দ্বীপেন রায়ের শেষ প্রচার মিছিল হয়েছিল প্রায় ১৫ মাইল লম্বা। গরিবের প্রার্থী হিসেবে তিনি আলোচনায় এসেও নৌকার তোড়ে উড়ে গিয়েছিলেন। ভোটের ফলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এত বছর পরে এসে ভাবি, সত্যি কি সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল খুব অপ্রত্যাশিত ছিল? নৌকার পক্ষের জনজোয়ারই তো ফলাফলের আগাম বার্তা জানিয়েছিল। আমি তখন নিজে ভোটার হইনি কিন্তু‘ নির্বাচনের প্রচার কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। আমি ও আমার বন্ধুরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দিতে বলিনি ঠিকই; কিন্তু মনে মনে কি আমরা আওয়ামী লীগের জয়ই প্রত্যাশা করিনি? হয়তো তাই আমাদের প্রার্থীর পরাজয় এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয়ে আমরা উৎফুল্ল না হলেও হতাশায় ভেঙে পড়িনি। আমরা তো মনে মনে চাইছিলাম, আমাদের এলাকায় আমাদের প্রার্থী জিতুক আর সারাদেশে জিতুক আওয়ামী লীগ। এমএনএ প্রার্থী গোলাম রহমানের পক্ষে প্রচার কাজে অংশ নিতে ঢাকা থেকে আমাদের এলাকায় গিয়েছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। তিনি ছিলেন ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেলেও মোহাম্মদ সুলতানকে খুব খুশি হতে দেখিনি। হতে পারে কারণ এটাই যে, যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির কট্টর সমালোচক এবং ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের প্রতিও তার বীতরাগ গোপন রাখতেন না। তবে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর আমাদের কাছে বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব ক্ষমতায় গিয়ে যদি কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন তাহলে কমিউনিস্টরা মুক্ত পরিবেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। কমিউনিস্ট বলতে তিনি মস্কো এবং পিকিংপন্থি- দুই গ্রুপকেই বুঝিয়েছিলেন কিনা সে প্রশ্ন তখন অবশ্য করা হয়নি। আগেই বলেছি, মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন পিকিংপন্থি এবং মস্কো লাইনের ঘোরতর বিরোধী। মস্কোপন্থিদের সামনে যেহেতু কথাটি বলেছিলেন, তাই ধরে নেয়া যায় মস্কোপন্থিদেরও তিনি বাদ দেননি। মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি। ১৯৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সময়ের দাবি পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখেই জন্ম হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের। এদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পাশাপাশি বাম-প্রগতিশীল চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের অবদান একক সংগঠন হিসেবে সবচেয়ে বেশি। আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু‘ তাতে ইতিহাসের সত্য বদলাবে না। মোহাম্মদ সুলতানের আরেকটি বড় কীর্তি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র প্রকাশক ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের পর প্রথম প্রকাশিত এই সংকলনের রাজনৈতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম। সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে, বিশেষ করে চীনপন্থার অনুসারী হয়ে মোহাম্মদ সুলতান তার মেধার অপচয় ঘটিয়েছেন বলে আমি মনে করি। প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হলেও সাধারণ মানুষের মন-মেজাজ বোঝার ক্ষেত্রে তার ঘাটতি ছিল বলেই তিনি রাজনীতির মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। মেধা অনুযায়ী রাজনীতিতে তার যে জায়গা হওয়ার কথা, সেটা হয়নি হয়তো মূলত তার খামখেয়ালির জন্যই। চীনপন্থি বলে পরিচিত বিপ্লবীরা নিজেরা তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক করে দল ভাঙায় যতটা সাফল্য দেখিয়েছেন, শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ায় ততটাই হয়েছেন অসফল। সত্তরের নির্বাচনের সময় মোহাম্মদ সুলতানের নিকটসান্নিধ্যে আসার সুযোগ হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে আমি লাভবান হয়েছি। তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব, যা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা বোঝার জন্য সহায়ক হতে পারে।

ঘটনা : এক নির্বাচনী প্রচারে তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি গ্রামে অনেক বাড়িতে আমি গিয়েছি। তিনি মানুষের সামনে ন্যাপ প্রার্থীকে ভোট দেয়ার পক্ষে কী যুক্তি তুলে ধরতেন, সেগুলো আমি মন দিয়ে শুনতাম এবং বোঝার চেষ্টা করতাম। ভোটে জেতার জন্য কোনো ফালতু প্রতিশ্রæতি নয়। মানুষকে রাজনীতি সচেতন করার পাঠ দিতেন যেন। তার কথা সাধারণ ভোটাররা খুব বুঝত বলেও মনে হয় না। আমাদের এলাকায় সত্তরে হিন্দু ভোটাররা ছিলেন ফলাফল নির্ধারণে প্রভাবক। তারা ছিলেন সাধারণত জোটবদ্ধ। সেজন্য বেশকিছু হিন্দু বাড়িতে আমি মোহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে গেছি। গ্রামে যারা প্রভাবশালী, যাদের কথায় অনেকের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়, এমন সম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজনের বাড়িতে আমরা গিয়েছি। কোনো ভণিতা না করে তারা আমাদের বলেছিলেন, প্রার্থী যোগ্য হলেও তারা গোলাম রহমানকে ভোট দিতে অপারগ। তাদের পছন্দের তালিকায় আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কিছু নেই। আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে, সেটা তারা দেখতে চাননি, বলেছেন, আমরা নৌকার পক্ষে। মোহাম্মদ সুলতান বলেছিলেন, ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত আপনাদের নিজস্ব। নিশ্চয়ই আপনাদের বিবেচনায় যাকে ভালো মনে করবেন, তাকেই ভোট দেবেন। কিন্তু‘ একটি কথা আমি বলে যাচ্ছি, মনে রাখবেন। বামপন্থিরা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হবে না। অন্যরা সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করবে, ভোটের জন্য তাদের ব্যবহার করবে, আবার তাদের সম্পদ লুণ্ঠনেও কুণ্ঠিত হবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও হিন্দুদের জীবন-সম্পদ-পূজা অর্চনার অধিকার নিরাপদ হবে বলে আমি মনে করি না। ১৯৭০ থেকে ২০২২। কী দেখছি আমরা? মোহাম্মদ সুলতান কি খুব ভুল কিছু বলেছিলেন?

ঘটনা : দুই সত্তরের নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর জানা গেল পাকিস্তানের পূর্ব অংশে মাত্র দুটি আসন ছাড়া বাকি সব আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল। মোহাম্মদ সুলতানের কাছে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি একটু চিন্তিত হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতা যতটুকু বুঝি, তাতে এটা জোর দিয়েই বলতে পারি যে তারা আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা ছাড়বে না। পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টো খুব খারাপ মানুষ। ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিলে তিনি শেষ পর্যন্ত কী করবেন বুঝতে পারছি না। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় যেতে হলে সশস্ত্র পথেই যেতে হবে। মোহাম্মদ সুলতানের কথা তখন আমাদের পছন্দ হয়নি। ভোটে জেতা দলকে আবার ক্ষমতার বাইরে রাখা যায় নাকি? তিনি নিজে সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতি করেন বলেই হয়তো তার মাথায় সশস্ত্র উপায়ের কথা ঘুরছে। কিন্তু‘ তিন মাস যেতে না যেতেই নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

ঘটনা : তিন এটা স্বাধীনতার পরের ঘটনা। ১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বেশ কয়েকবার তার বাসায় গিয়েছি। দেখেছি তার দীনহীন অবস্থা। তার রাজনৈতিক অবস্থান চরম মুজিববিরোধী। আমাকে শুধু বলতেন, ফরহাদকে (মোহাম্মদ ফরহাদ, তখন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক) বলো মুজিব-সমর্থনের রাজনীতি পরিহার করতে। আমি মুজিবকে খুব ভালো করে জানি। জানি তার বিদ্যার দৌড়। সাহস আর আবেগ হলো তার রাজনীতি। দেশ যে পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে তা সামাল দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। আবেগ দিয়ে দেশ শাসন হয় না। মোহাম্মদ সুলতানের এই বার্তা আমি ফরহাদ ভাইকে পৌঁছে দিয়েছি। মোহাম্মদ ফরহাদ বলেছিলেন, মুজিববিরোধিতা করে নয়, বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে মুজিবকে সঙ্গে নিয়েই। ১৯৭৫ সাল। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ততদিনে বাকশাল গঠিত হয়েছে। রাজনীতিতে এক গুমোট হাওয়া। জনসভার প্রচারের জন্য ঘোড়ার গাড়িতে মাইক বেঁধে আমি বাংলাবাজারের দিকে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মোহাম্মদ সুলতানের সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। সকাল ১১টার দিক। তার শরীরটা বেশি ভালো ছিল না। চা খাওয়ালেন। আর বললেন, এত টাকা খরচ করে, এত ঢাকঢোল পিটিয়ে জনসভা করে কী লাভ? তোমরা দেখছ দ্বিতীয় বিপ্লব, আমি দেখছি রক্ত। প্রতিবিপ্লবী শক্তি কোন বেশে আসছে আমি জানি না। তবে আসছে, এটা নিশ্চিত। মাত্র কয়েক মাস পরের কথা আমরা সবাই জানি। আমাদের সামনে এসেছিল নিষ্ঠুর আগস্ট, দুঃসহ আগস্ট, বেদনার আগস্ট, রাষ্ট্রপিতাকে হারানোর মর্মান্তিক কান্নার আগস্ট। বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতেন না। কিন্তু‘ মানুষের প্রতি শর্তহীন উদারতা ও ভালোবাসা দেখিয়ে কী লাভ হলো তার?

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App