পরিবেশ, প্রাণ, প্রকৃতি রক্ষা করতে হবে
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৮ এএম
মানুষ মাত্রই প্রকৃতির সন্তান। কেবল মানুষ বলি কেন, সমস্ত প্রাণিকুল বেঁচে-বর্তে রয়েছে প্রকৃতির ছায়াতলে-অবদানে। জল, বায়ু, নদী, বনায়ন, জলাধার, গভীর সমুদ্র, বৃষ্টি-বর্ষণ সবই প্রকৃতির উপাদান। প্রকৃতির উপাদানগুলো ব্যতীত প্রাণিকুলের বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। প্রকৃতির নির্ভরতায়ই মানুষ এবং প্রাণিকুলের বেঁচে থাকা। এই সত্যটি আমরা কতটুকু স্মরণে রেখে চলি- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন রূপে দেখা দিয়েছে। আদিমযুগ হতে মানুষ প্রকৃতির আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে। প্রকৃতির নানা প্রতিকূলতাকে স্বীয় বুদ্ধিমত্তায় অতিক্রম করে নিজেদের রক্ষা করেছে। প্রকৃতির নানা নিষ্ঠুর আচরণ থেকে নিজেদের রক্ষার কৌশল রপ্ত করেছে। কিন্তু প্রকৃতি ধ্বংসে আত্মঘাতী পথ অবলম্বন করেনি। প্রকৃতির প্রতি মানুষের সহজাত সহমর্মিতা লোপ পেয়েছে পুঁজিবাদের আগমনে। আদিম যুগে, সামন্ত বা দাস যুগেও মানুষ প্রকৃতিবিরোধী হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের ছন্দপতন ঘটে পুঁজিবাদী যুগের আগমনে। পুঁজিবাদ এমন এক নিষ্ঠুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা- যা মুনাফা ছাড়া কিছু বোঝে না। মুনাফার কারণে হেন কোনো অপকীর্তি নেই- যা পুঁজিবাদ করতে না পারে। প্রকৃতির প্রতি অনাচার শুরু হয়েছে পুঁজিবাদের আগমনের পরই এবং সেটা ক্রমেই ভয়ানক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আমাদের চারপাশে প্রকৃতি ধ্বংসের যে মহোৎসব চলছে, সেটা পুঁজিবাদেরই তাণ্ডব। যে মানুষ আদিকাল থেকে প্রকৃতির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছে। পুঁজিবাদের আগমনের পরই সেই সহাবস্থানে দ্রুত ছন্দপতন ঘটে। মুনাফা-পার্থিব লোভ-লালসা সেই মানুষকেই দ্রুত বদলে দিয়েছে। প্রকৃতি ধ্বংসে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি ব্যাহত করে মুনাফার তাগিদে ভয়ংকর অনাচার শুরু হয়েছে। প্রকৃতি বিনাশের নানা অপতৎপরতার মূলে রয়েছে মুনাফা। উন্নত বিশ্ব তাদের উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রকৃতি বিনষ্টে বিশ্বের জলবায়ুর ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলে চলেছে, তার খেসারত গুনতে হচ্ছে গরিব বিশ্বকে। বিশ্ব আবাস এবং আবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ার মূলে উন্নত বিশ্বের প্রকৃতিবিরোধী অপকীর্তি। যাকে পুঁজিবাদী আগ্রাসন বলেই চিহ্নিত করা যায়। পূর্বেই বলেছি পুঁজিবাদ মুনাফা ভিন্ন কিছু বোঝে না। পুঁজিবাদের বিকাশেই প্রকৃতির সর্বনাশ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রকৃতির প্রতি সামগ্রিক নিষ্ঠুর আচরণে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নিচ্ছে। নানা নতুন-নতুন নামে প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরণ-তাণ্ডব আমরা দেখছি। সেটা প্রকৃতির বদলা বলেই গণ্য করা যায়। পুঁজিবাদী তৎপরতার মাশুল যেমন দিচ্ছে গরিব বিশ্ব। একইভাবে প্রকৃতির তাণ্ডবের মাশুলও দিতে হচ্ছে গরিব বিশ্বকেই। পুঁজিবাদ চরমভাবে স্বার্থবাদী। পুঁজিবাদ সামষ্টিক ভাবনার বিপরীতে ব্যক্তি ভাবনা- ব্যক্তি স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সমষ্টির বিবেচনা পুঁজিবাদ করে না। ব্যক্তির উন্নতির পথকেই উন্মুক্ত করে দেয়। ব্যক্তির উন্নতিতে সমষ্টির দুর্গতি পুঁজিবাদ আমলে নেয় না। আমাদের চারপাশে ব্যক্তির উন্নতির যে জোয়ার আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সেটা পুঁজিবাদেরই দৃশ্যমান তৎপরতা। প্রকৃতিবান্ধব মানুষ আজ বিপন্ন। প্রকৃতি ধ্বংস-দূষণ প্রক্রিয়ায় গরিব বিশ্ব দিচ্ছে সর্বাধিক মাশুল। যার বিরুদ্ধে বড় জোর প্রতিবাদ হচ্ছে। হচ্ছে আর্থিক মুচলেকা নেয়ার দর কষাকষি। কিন্তু প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে একাট্টা হয়ে গরিব বিশ্বকে রুখে দাঁড়াতে আমরা দেখছি না। ধনিক বিশ্বের কাছে পদানত হয়ে পড়েছে গরিব বিশ্ব। সে কারণেই ধনিক বিশ্ব লাগামহীন-বেপরোয়া। নিজেদের উন্নতির বাইরে কিছুই বিবেচনা করছে না। সাম্রাজ্যবাদীদের নিরঙ্কুশ এবং অব্যাহত আগ্রাসনে গরিব বিশ্ব রুখে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতার দায় বহন করে চলেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘বাঘ বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। আর সুন্দরবন বাঁচাবে বাংলাদেশকে। আসুন আমরা সবাই মিলে বাঘ বাঁচাই।’ বাঘ রক্ষার বৈশ্বিক উদ্যোগের অগ্রগতি পর্যালোচনা বিষয়ক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনের অবস্থান। এছাড়া এই বনভূমির ওপর ১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। অতি সত্য-সুন্দর কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। বাংলাদেশের প্রকৃতির অনন্য অবদান সুন্দরবন। প্রকৃতির নানা তাণ্ডব থেকে সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করে এসেছে। প্রাণী বৈচিত্র্যের জন্যও সুন্দরবনের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সুন্দরবন ধ্বংসের নামান্তর। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তিকে অনায়াসে দেশবিরোধী চুক্তি বলা যায়। দেশের জনগণকে পাশ কাটিয়ে করা সেই চুক্তি জানলে দেশপ্রেমিক একজন ব্যক্তিও সমর্থন করতে পারবে না। বরং আঁতকে উঠবে। সর্বনাশা এই চুক্তিতে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ৭০ শতাংশ ব্যয় বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ৭০ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের দায় সম্পূর্ণ বাংলাদেশের। সুদাসলসহ তা পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ ব্যয়ের ১৫ শতাংশ বাংলাদেশ এবং ১৫ শতাংশ ভারত বিনিয়োগ করবে। অথচ উৎপাদনের ৫০ শতাংশ করে পাবে বাংলাদেশ এবং ভারত। কী ভয়ংকর অপরিণামদর্শী এই চুক্তি! আমাদের ভূখণ্ডে, ৭০ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের দায়ভারসহ আরো ১৫ শতাংশ বিনিয়োগের পর অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ বিনিয়োগের দায় মাথায় নিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ঋণ-ভূখণ্ডের দায়হীন হলেও পাবে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা সুন্দরবনের নিকটবর্তী। তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের গৌরব-গর্বের এবং ঐতিহ্যের ধারক সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে। সুন্দরবন বলে আমাদের অংশের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। থাকবে কেবল ভারতীয় অংশের সুন্দরবন। চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আমদানির দায়ভারও বাংলাদেশের। কয়লার অপ্রাপ্তি কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যাহত হলে- তার দায়ও বাংলাদেশের ওপর বর্তাবে। এনটিপিসি কেবল লাভের অংশই নেবে, লোকসানের বোঝা বইবে না। চুক্তিতে তেমনটাই রয়েছে। ধারণা করা যায় এই কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের চারগুণ বেশি হবে। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ বেসরকারি ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে ২০ ডিসেম্বর ২০১১ পিডিবি চুক্তি করেছে ৫২২ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায়। ২৮৩ মেগাওয়াটের খুলনার লবণচারায় এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। সরকার মাওয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৪ টাকায় এবং লবণচরা ও আনোয়ারার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয় করবে। তাহলে কোন অভিলাষে সরকার রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি করছে? ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রামপালে ১৮৩৪ একর জমি বেছে নেয়া হয়েছে। যার প্রায় সমস্তই কৃষি জমি। প্রস্তাবিত এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে আবাদ ও আবাসের পাশাপাশি মৎস্য খামার, চিংড়ি চাষ প্রকল্প, সবজিক্ষেত, গবাদিপশু এবং উৎপাদিত দুগ্ধ খামার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সামগ্রিকভাবে ওই অঞ্চলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। কৃষক, কৃষি ব্যবস্থাসহ স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা বলে অবশিষ্ট কিছু থাকবে না। জনপদটির মানুষ উৎপাটিত হয়ে যাবে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, কঠিন ও তরল বর্জ্য, পানি দূষণসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যা ওই অঞ্চলেরই কেবল নয়- সুন্দরবনের বিলুপ্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অগুনতি ক্ষতির বিষয়গুলো বিবেচনা না করে ভারত সরকারের সঙ্গে যৌথ তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অসম-দেশবিরোধী চুক্তি অবিলম্বে বাতিল না করলে দেশ-জাতিকে চড়া মাশুল দিতে হবে। পরিবেশ-প্রকৃতির অভাবনীয় ক্ষতি পূরণের উপায় থাকবে না। কৃষিজমি, নিকটবর্তী জনবসতি, নদীর পানির স্বল্পতা, পরিবেশগত হুমকির বিবেচনায় ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) ভারতের মধ্যপ্রদেশে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছিল। সেই এনটিপিসি-ই বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে বেছে নিয়ে কথিত যৌথ বিনিয়োগে একই রকমের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে ভারতের কর্নাটক রাজ্যের রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের ২০ কিলোমিটারের দূরত্বে এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনাও জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ভারত সরকার বাতিলে বাধ্য হয়। আমাদের সুন্দরবনের চেয়ে আয়তনে দশভাগের একভাগ পরিধির রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে জনগণের প্রতিরোধের মুখে ভারত সরকার পিছু হটে প্রকল্প বাতিলে বাধ্য হয়। সুন্দরবন আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক, জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত সমাহার সেখানে। রামসার সাইট। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষিত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। যে বিবেচনায় খোদ ভারত নিজ ভূখণ্ডে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেনি। আমরা কোন বিবেচনায় সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে পারি? অবিলম্বে পরিবেশ ও সুন্দরবন ধ্বংসের অপতৎপরতা ঠেকাতে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে পরিবেশ-প্রকৃতি বিনাশের সমস্ত অপচেষ্টা। সুন্দরবনকে বিশ্বের আশ্চর্য স্থানে অন্তর্ভুক্তির জন্য যারা আদাজল খেয়ে প্রচারণা চালিয়েছিল, তারা আজ কোথায়? এখন তো সুন্দরবনই থাকবে না- যদি সরকার ভারতীয় চক্রান্তে চুক্তি বাস্তবায়ন করে। তাই অবিলম্বে জরুরি রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা। জনগণের প্রতিরোধে দেশ, দেশের সম্পদ, প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে বলেই বিশ্বাস করি। প্রকৃতি-পরিবেশ আমাদের স্বার্থেই রক্ষা করতে হবে। নয়তো প্রকৃতি-পরিবেশ বিনাশের মাশুল ভয়ানকভাবে দিতে হবে আমাদেরই। এটি যেন ভুলে না যাই।
মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]