×

স্বাস্থ্য

বহুমাত্রিক হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২২, ০৮:২৩ এএম

বহুমাত্রিক হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রতীকী ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জলবায়ু পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব সর্বত্র সমান নয়। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি, সংবেদনশীলতা ও অভিযোজনের ক্ষমতা ভিন্ন। এরই মধ্যেই জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব যে সবক্ষেত্রে পড়তে শুরু করেছে, এ বিষয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘের শিশু তহবিলসহ (ইউনিসেফ) আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গবেষণায় উঠে এসেছে। এ থেকে পরিত্রাণের পথও খুঁজছেন বিশ্ব নেতারা। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের একটি অন্যতম পদক্ষেপ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড আর নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ। কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীষ্মকাল অনেক বেশি দীর্ঘ ও উষ্ণ হচ্ছে এবং শীতকাল হয়ে উঠছে আরো উষ্ণতর। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হার। কমছে মৌসুমি বৃষ্টিপাত। বাড়ছে অসময়ে ঝড়-বৃষ্টির প্রবণতা। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যাহত হওয়ার সঙ্গে বাড়ছে মাটির লবণাক্ততাও। এতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রোগব্যাধির জন্ম হচ্ছে। বিভিন্ন ভাইরাস ও ছোঁয়াচে রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ, চর্মরোগ, রক্তশূন্যতা, ডায়রিয়া, কলেরা, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগব্যাধি বাড়ছে। বাড়ছে মানসিক রোগ ও আত্মহত্যার ঘটনা। এমন কি প্রসূতি, ভ্রূণ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসহ মানুষের গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সবার ওপরই পড়ছে; তবে কম বয়সিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিরাপদ থাকছে না গর্ভের শিশুও।

যা বলছে গবেষণা ও তথ্য উপাত্ত : সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পৃক্ততা তুলে ধরা হয়েছে। আবহাওয়া মানুষের উদ্বিগ্নতা ও বিষাদগ্রস্ততাকে প্রভাবিত করে। যেমন- গ্রীষ্মকালে মানুষ বর্ষাকালের চেয়ে কম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্নতাও বেড়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং মশার কামড়জনিত রোগসহ নানা মানসিক রোগের মাত্রা বেড়েছে।

২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ডব্লিউএইচওর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়ে মানব স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। তাপদাহ, ঝড়, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় আঘাত, রোগব্যাধি ও মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বাড়ছে। এগুলো বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অসমভাবে প্রভাবিত করছে- যা গত পাঁচ দশকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অগ্রগতিকে বিপরীতে নেয়ার হুমকি সৃষ্টি করছে।

আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পানীয় জলের সঙ্গে যে পরিমাণ লবণ নারীদের দেহে প্রবেশ করছে, তার প্রভাবে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাত বেশি হয়। এছাড়া জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেয়ার হার বেড়েছে। ফলে এ অঞ্চলের নারীর প্রজনন ক্ষমতা দিন দিন কমছে।

২০২১ সালে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ৫ বছর ৪ মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় ৭ বছর ৭ মাস। গবেষণা বলছে, দেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতেই বায়ু দূষণের হার ডব্লিউএইচওর নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত ৩ গুণ বেশি। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ৬ মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ু দূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় ২ বছর ৮ মাস, ২০১৯ সালে সেটি ৫ বছর ৪ মাসে দাঁড়িয়েছে।

২০২১ সালে প্রকাশিত ‘জলবায়ু সংকট মূলত শিশু অধিকারের সংকট : শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরআই) প্রবর্তন’ শীর্ষক ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়ার অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম।

২০২১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে স্বাস্থ্য খাতকে কার্বনমুক্ত করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। বাংলাদেশসহ ৪৭টি দেশ কপ-২৬ হেলথ প্রোগ্রাম অনুসারে, নিজ নিজ স্বাস্থ্য খাত থেকে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে একে জলবায়ুবান্ধব করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি দেশ টেকসই ও কম কার্বন নিঃসরণ করে এমন স্বাস্থ্য খাত গড়ে তুলবে, যার মধ্যে বাংলাদেশও আছে।

ডব্লিউএইচওর মতে, ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ও গরমের কারণে প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা আরো আনুমানিক আড়াই লাখ বেড়ে যাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর স্বাস্থ্যের প্রত্যক্ষ ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ দাঁড়াবে ২০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : জলবায়ু পরিবর্তন মানবদেহে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী জানান, দৈহিক, মানসিক এবং সংক্রামক বা অসংক্রামক সব রোগের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। বিষয়টি ব্যাখা করতে গিয়ে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণতা বাড়ছে। এতে রোগজীবাণুর ধরন বদলে যাচ্ছে। সংক্রামক রোগগুলো নতুন মাত্রা পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনসহ ক্রনিক ডিজিজেরও প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে শরীরে যে পরিবর্তন হয়, তা ক্রনিক ডিজিজগুলোকে বাড়িয়ে দেয়। যে রোগগুলো বনবাদাড়ে সীমাবদ্ধ থাকত, বনবাদাড় পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে সেগুলো এখন মানুষের শরীরে স¤প্রসারিত হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব হচ্ছে লবণাক্ত উল্লেখ করে ডা. লিয়াকত আলী বলেন, আমাদের খাদ্যচক্রে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। এতে হাইপার টেনশন বাড়ছে। বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ায় এসব কীটনাশক বিভিন্ন মাধ্যমে আবার মানবদেহেই ঢুকছে। যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারজাতীয় রোগ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে বক্ষব্যাধি রোগ। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ আমাদের শরীরে ঢুকছে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ শরীর থেকে বের করতে কিডনি ও লিভারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। অনেক পদার্থ আবার শরীরেই থেকে যায়। দূষণের ফলে মানসিক অশান্তিও বেড়ে যায়।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেনের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ- দুভাবেই মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পুষ্টিহীনতার মুখে পড়বে। এতে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গর্ভবতী নারী এমনকি গর্ভের শিশুর ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, যেহেতু পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে, তখন বিশুদ্ধ পানির অভাবে সংক্রামক ব্যাধি, পেটের পীড়ায় মানুষ বেশি ভুগবে। খাদ্যবাহিত রোগ আসবে। তাপমাত্রা বাড়লে মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া বেড়ে যাবে। বৃষ্টির সময়ে ঠাণ্ডা বা ঠাণ্ডার সময়ে বৃষ্টি হলে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে যে রোগগুলো ছড়ায়, সেগুলো ছড়াবে। মলমূত্র ও স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় এমন রোগবালাই ছড়াবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে সুন্দরবনের একটি অংশসহ উপকূলবর্তী কিছু অঞ্চল ডুবে যাবে এবং মধ্যবর্তী বাংলাদেশে লবণাক্ত পানির আগ্রাসন ঘটবে। এর প্রভাবে আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান- দুটোরই ভারসাম্য নষ্ট হবে। পরিবেশ বিপর্যয়জনিত অসুখ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনস্বাস্থ্যকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাবে। লবণাক্ততা বেড়ে গেলে শস্য উৎপাদনে এর প্রভাব পড়বে। মানুষ তখন বিকল্প খাদ্যের দিকে যাবে। তাতে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App