×

মুক্তচিন্তা

উদাসীনতাজনিত দুর্ঘটনায় ১১ ছাত্রের জীবন হরণ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২২, ১২:০৭ এএম

আমাদের দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এর লাগাম কিছুতেই টানা যাচ্ছে না, যাবে বলেও মনে হয় না। কারণ দুর্ঘটনার কোনো সংজ্ঞায় এসব সড়ক দুর্ঘটনাকে কোনোভাবেই ফেলা যায় বলে মনে হয় না। কেননা দুর্ঘটনার পেছনে মানুষের ইচ্ছা, সচেতনতা কোনোভাবে কাজ করে না। কিন্তু আমাদের দেশে যেসব সড়ক দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে সেসবের বেশিরভাগই অংশীজনদের উদাসীনতাজনিত কারণেই ঘটে থাকে। আজকাল মোটরসাইকেল যত্রতত্র যে সে ব্যবহার করা শুরু করেছে। কোনো প্রশিক্ষণের ধার অধিকাংশই ধারে না। রাস্তায় মোটরসাইকেল চালানোর নিয়মও মানতে চায় না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কারণ রাস্তায় অন্য যানবাহনগুলোরও কারো কারো নেই বৈধ লাইসেন্স, কারো কারো ড্রাইভার অদক্ষ, রাস্তায় যাতায়াতে নিয়ম মানার বোধে নেই। যেখানে সেখানে ওভারটেক করার বিষয়টিকে নিজের খামখেয়ালি মতো করতে এরা এতটুকু দ্বিধা করে না। পরিবহন সেক্টরের অধিকাংশ মালিক এসব আনাড়ি অদক্ষ লাইসেন্সবিহীন চালকদের হাতে নিজেদের যানবাহনটি তুলে দিতে দ্বিধা করেন না। মালিকদের অনেকেই কীভাবে মালিক বনে গেছেন সেটি আরেক আরব্য উপন্যাসের গল্পকথা হতে পারে। যানবাহন নিয়ে আমাদের দেশে যেভাবে রাস্তাঘাটে যে কেউ মালিক, ড্রাইভার, হেলপার বনে যেতে পারে- সেটি পৃথিবীর উন্নত কেন অনেক আধা উন্নত দেশেও কেউ কল্পনা করতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো দেশেই গাড়ির লাইসেন্স পেতে কতবার পরীক্ষা দিতে হয়, গাড়ি সম্পর্কে জ্ঞানের দক্ষতায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়মবিধি অতিক্রম করতে যেতে হয়- সেটি কেবল সে দেশে যারা গেছেন তারাই ভালো জানেন। উন্নত দেশগুলোতে যে কোনো যানবাহন বা পরিবহনের ড্রাইভার হতে দু-চার বছর পরীক্ষা দিয়েই তবে কেবল উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। যে কোনো যানবাহন নিয়ে রাস্তায় চলাচল করা যায় না। আবার রাস্তায় কেউ বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে খুব বেশিদূর এগোতে পারবে না। এমনকি নির্ধারিত গতির সীমা সামান্যতম অতিক্রম করেও কেউ বেশিদূর অগ্রসর হতে পারবে না। যন্ত্র প্রযুক্তির মাধ্যমেই নিয়ম বা আইন ভঙ্গকারী হয় ধরা পড়ে যাবে নতুবা তার গাড়ি আপনাআপনিই থেমে যাবে। তারপরও সেসব দেশেও দুর্ঘটনা ঘটে। সেগুলোকে দুর্ঘটনার সংজ্ঞায় ফেলা যায়। কিন্তু আমাদের এখানে সামান্য একটি রিকশায় বসেও নিজেকে নিরাপদ ভাবা যায় না। পেছন থেকে যে কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে। এরপর রাস্তায় পিষ্ঠ হয়ে মারা যেতে সময় নাও লাগতে পারে। এই ঢাকা শহরে যদি যানজট না থাকত তাহলে বোধহয় ঘর থেকে বের হয়ে ফিরে আসার কথা অনেকেই প্রতিদিন ভাবতে পারত না। কেউই আইন নিজে মানতে চায় না, চায় অন্য যে কেউ যেন মেনে চলে। কিন্তু অন্য বাহকও তো একই ভাবনাই ভাবছে। ফলে যা ঘটছে তা স্বাভাবিক কোনো দুর্ঘটনা নয়, অনিবার্য হত্যাকাণ্ড বলেই আজকাল অনেকে দাবি করে থাকেন। এছাড়া রাস্তায় যারা ট্রাফিক দায়িত্ব পালন করেন তাদের কজনইবা এতসব অবৈধ, অদক্ষ, চলাচলের অযোগ্য পরিবহনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখছেন। প্রায় প্রতিটি যানবাহনই যদি কোনো না কোনো নিয়ম অনুসরণ না করে রাস্তায় চলে তাহলে কে ঠেকাবে এতসব পরিবহনকে? রাস্তাঘাট ভালো হচ্ছে, খুশির খবর। সেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যে কোনো পরিবহন নিয়ে বেপরোয়া গতিতে নিয়ম ভঙ্গ করে চলার প্রবণতা দেখে মনেই হয় না ওই পরিবহনের চালক বা যাত্রীদের কারোরই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সামান্যতম মানবিক সচেতনতার অবস্থানে রয়েছে। এই বেপরোয়া মনোভাব বেড়ে ওঠে মূলত ছোটকাল থেকে। আইন, নিয়মকানুন, বিধিবিধান মেনে চলার প্রাথমিক ধারণা ও শিক্ষা লাভের অভাব থেকে। এরপর পরিবহন খাতে যে লাখ লাখ যুবক ড্রাইভার কিংবা হেলপার হয়ে আসে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার যেমন অভাব রয়েছে, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থার মধ্যেও নানা অবাধ্যতার ভেতর দিয়েই তাদের বেড়ে ওঠার অবস্থান রয়েছে। পরিবহন খাতের অভ্যন্তরেও না আছে কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা, বিধিবিধানের কার্যকারিতা, চাকরিবিধির শৃঙ্খলা, জীবনাচরণের স্বাভাবিক পরিবেশ। অথচ এদের হাতেই উঠছে সব ধরনের যানবাহন যা সামান্যতম অজ্ঞানতার কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পতিত হতে বাধ্য। সেগুলোই প্রতিদিন ঘটছে। মাওয়া বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে এখন প্রায় প্রতিদিনই নানা অনিয়ম দুর্ঘটনার খবর শুনতে হচ্ছে। কারণ সেখানে কেউই নিয়ম মানছে না। তাহলে আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা নির্মাণ করেও সড়ক দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারব কীভাবে? আমরা বাঙালিরা কি সত্যিই কোনো আধুনিক ব্যবস্থার সুফল ভোগ করতে আদৌও সক্ষম কিনা সেটি বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব জায়গাতেই নিয়ম ভাঙাটাকে নিয়মে পরিণত করে ফেলছি! কোথাও শৃঙ্খলা, আইন, নিয়মকানুন মেনে চলতে চাচ্ছি না। গত ২৯ জুলাই মিরসরাই বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের সঙ্গে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় ১১ জন ছাত্রের মৃত্যুর খবর সবাইকে কমবেশি শোকাহত করেছে। ১১ জনই ছিলেন স্কুল এবং কলেজপড়ুয়া ছাত্র। গুরুতর আহত ৫ জন চট্টগ্রাম মেডিকেলে জীবন আশঙ্কায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন, আরেকজনের অবস্থা এখন ভালো। এদের সবারই বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার আমান বাজার যোগীরহাট এলাকায়। যদিও এরা স্কুল এবং কলেজের শিক্ষার্থী, কিন্তু তাদের খৈয়াছড়া ঝরনা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টার ‘আর এন্ড জে প্রাইভেট কেয়ার’। আজকাল গ্রামেও বাহারি নামের নানা কোচিং সেন্টার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এমনভাবেই লেখাপড়ার নামে প্রলুব্ধ করে থাকে, যা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার কথা নয়। কিন্তু কোচিং সেন্টার তো কোনো বিধিবদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। নাহলেও তাতে কি? অভিভাবকদেরও একটি অংশ কোচিং সেন্টারের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা দেখাতে এখন সচরাচর দেখা যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা অনেক আছে। সেই দুর্বলতার ফাঁকফোকরগুলোই কোচিং সেন্টারগুলো ব্যবহার করে থাকে। অনেক কোচিং সেন্টারই নানা ধরনের মডেল টেস্ট দেখিয়ে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করে থাকে। তাদের ধারণা মডেল টেস্ট হলেই কেবল শিক্ষার্থীরা ভালো করতে পারবে। ভালো করলেই তো পরীক্ষায় জিপিএ-৫ কিংবা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার নিশ্চিত সাফল্য নির্ভর করবে। তাছাড়া কোচিং সেন্টারগুলো সময়ে সময়ে পিকনিক, স্টাডি ট্যুরের নামে বিভিন্ন জায়গায় নেয়ারও ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তবে মনে রাখতে হবে কোনোটাই বিনা পয়সায় নয়। কইয়ের তেলে কই মাছ ভাজা আরকি! বেশ কিছু কোচিং সেন্টার গ্রামেও এ ধরনের আয়োজনের ব্যবস্থা করায় অনেক অভিভাবকই সন্তানদের কোচিং সেন্টারে দিয়ে থাকেন। অনেক সন্তানেরও বায়না থাকে। অগত্যা অভিভাবকদের সেই বায়না পূরণ করতেই হয়। এই শিক্ষা নিয়ে এমন আচরণ মোটেও শিক্ষার নিয়মে পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশে নিয়ম মানার কোনো নিয়ম তো নেই, বরং ভাঙারই নিয়মটা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ দুর্ঘটনার অনেক কিছুই এখন আমরা কেটেকুটে জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করাতে পারি। সেটিও নিয়মে হবে না। ধরা যাক ওইদিন যেসব শিক্ষার্থীকে হাটহাজারীর আমান বাজার থেকে ৬৪ কি.মি. দূরে খৈয়াছড়া দেখাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ ‘আর এন্ড জে প্রাইভেট কেয়ারের’ কর্তৃপক্ষ এমন একটি দায়িত্ব নিতে গেলেন কেন সেটি তো একটি মৌলিক প্রশ্ন। তারা কি সড়কপথের দুর্ঘটনার কথা জানেন না? যদি জেনে-বুঝেই তা করে থাকেন তাহলে তাদের তো শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সতর্কতার জন্য আরো অনেক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল। তারা গেলেন ড্রাইভারসহ ১৮ জন। অথচ ওই মাইক্রোবাসে ১০-১২ জনের বেশি বহন করা মোটেও আইনসম্মত ছিল না। এরপর খৈয়াছড়া থেকে রওনা দেয়ার সময় রেলগেটে এসে একবারও কি মহানগর প্রভাতী ট্রেনের আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি কিংবা রেলটি সেই সময় ক্রসিংয়ের কাছাকাছি চলে আসার দৃশ্যটি সম্মানিত দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কেউ কি দেখেননি? মাইক্রোবাসটি নিজেদের নাকি ভাড়া করা সেটি জানি না। সেটির চালকও কি কিছুই দেখেনি নাকি চালক স্বভাবগতভাবেই রাস্তা ক্রস করতে রেলগাড়িকেও তোয়াক্কা করতে চায়নি? রেলক্রসিংয়ের রেলগেট কিংবা বার ফেলা ছিল না। এটি তো বাংলাদেশে রেললাইনগুলোর স্বাভাবিক চিত্র। ব্যতিক্রম শুধু যেখানে গেটটি লাগানো হয়। কারণ গেটম্যানদের বেশিরভাগই কাজ নয়, চাকরি করেন। কাজ করতে হয়, চাকরিতে কাজের বালাই খুব কমই থাকে। সরকারি হলে তো কথাই নেই। কদিন আগে গাজীপুরের মাইঝপাড়া ক্রসিংয়েও তো একই ঘটনাই ঘটেছে। তাতে কী হলো? গেট না লাগানোর অজুহাতের তো শেষ নেই। সাক্ষী-সাবুদেরও অভাব হয় না। ন্যায়-অন্যায় বলে আমাদের তো কিছু মানার অভ্যাস নেই। মিরসরাইতেও কোচিং সেন্টার, মাইক্রোবাস, রেলগেট যার কথাই বলবেন কেউই তো দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়নি। ট্রেনকে দোষ দেয়ার তো কোনো উপায় নেই। এত বড় ট্রেন যদি মাইক্রোবাস না দেখে কিংবা অবহেলা করে তাহলে যা ঘটার তাই ঘটবে। ঘটেছেও তাই। কিন্তু‘ সবার ভুল একত্রিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিভিয়ে দিল ১১টি কিশোর ও তরুণ ছাত্রের জীবন প্রদীপ। ১১টি পরিবার এখন সন্তানহারা। বাকি ৫ জনের কজন বেঁচে উঠতে পারেন তা পরেই কেবল দেখা যাবে। কিন্তু‘ বেঁচে থাকলে এই ১১টি শিশু-কিশোরের মধ্য থেকে হয়তো সবাই, নতুবা কেউ কেউ একদিন গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করত। অন্তত পরিবারের হাল তো সবাই ধরতে পারত। এ হচ্ছে অংশীজনদের উদাসীনতাজনিত সড়কে নরহত্যা। যার কোনো ক্ষতি কেউ কোনোদিন কোনোভাবে পুষিয়ে দিতে পারবে না। প্রতিদিন আমাদের সড়কগুলোতে এ ধরনের জীবনহরণই কেবল ঘটছে। জীবনহরণের এই মিছিল হয়তো কেবল চলতেই থাকবে। কমবে তখনই যখন আমরা বিবেক, বুদ্ধি, আইন, নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে অভ্যস্ত হব। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App