চীন-আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর নিয়ে কৌতূহল
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২২, ১০:২৮ পিএম
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশেল জে. সিসন ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ফাইল ফটো
চলতি সপ্তাহের শেষে এবং আগামী সপ্তাহের গোড়ার দিকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের ঢাকা সফর নিয়ে কৌতূহল জেগেছে। আগামী ৬ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে দুই পরাশক্তির উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধির সফরে কী কী আলোচনা হবে সে নিয়ে শুরু হয়ে গেছে বিস্তর আলোচনা। আগামী ৬ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে ঢাকা সফরে আসছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশেল জে. সিসন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে সবাই কাছে পেতে চাইছে। এ কারণে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাটেল গ্রাউন্ডে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে মিশেল জে. সিসন এবং ওয়াং ই’র বাংলাদেশ সফর অন্তত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ করছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলন আমন্ত্রণ জানায়নি। বাংলাদেশের এলিট ফোর্স কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান এবং সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক নানা রকম বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছে।
সরকারের সূত্র মারফত জানা যাাচ্ছে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র ঢাকা সফরের বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। তার সফরকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সরকার। এ নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
সোমবার বিকেলে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। কী কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু, চীনের সহায়তায় বিভিন্ন চলমান এবং ভবিষ্যৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এছাড়া করোনার সময়ে চীন বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে এই অঞ্চলে বা বিশ্বে তারা কী করতে চায়, সেটি নিয়েও হয়তো তারা আমাদের জানাবে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগস্টের ৬ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে আসতে চাইছেন।
২০১৭ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আগামী রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের আগ্রহেই এ বৈঠক হচ্ছে বলে উভয় পক্ষের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। বৈঠকে যোগ দিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আগামী শনিবার দুই দিনের সরকারি সফরে ঢাকায় আসবেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কম্বোডিয়ায় আসিয়ানের মন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠক শেষে একই দিন রাতে ফিরবেন। সে কারণে শনিবারই বৈঠক আয়োজন সম্ভব হবে না বলে বাংলাদেশ চীনকে জানিয়েছে।
বর্তমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী। সোমবার তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আলোচনার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চীনের উদ্যোগে গঠিত ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থা ও তাদের প্রভাব কাজে লাগানো। ওয়াং ই সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করেছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যা বিষয়ে মামলা চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এতে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর আসিয়ানের আন্তর্জাতিক মহলেও কিছু চাপ তৈরি হয়েছে। এ কারণে এই সফর বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগও বটে।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোট (আইপিএস) ও ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক জোট (আইপিইএফ) কার্যকর করার ক্ষেত্রে আমেরিকা, ভারত ও জাপানের তৎপরতাও এখন চোখে পড়ার মতো। এই প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক উদ্যোগের বাইরে কোনো কৌশলগত ও সামরিক জোটে বাংলাদেশ যোগ দেবে না বললেও চীন এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠক আছে। জাতিসংঘে তাইওয়ান প্রসঙ্গ এলে বাংলাদেশের সমর্থন চীনের দরকার হবে। শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রেক্ষাপটে ঋণের ফাঁদ নিয়ে যে কথা রটেছে, বাংলাদেশসহ বন্ধুরাষ্ট্রকে সেসব বিষয়ে চীন আশ্বস্ত রাখতেও চাইবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে ঢাকার কূটনীতিকেরা মনে করছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা, রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বাণিজ্য-সংকট, বৈশ্বিক খাদ্য, জ্বালানি ও বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ সংকট এবং চীনের দুই উদ্যোগ গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ নিয়েও ওয়াং ই কথা বলতে চাইবেন। তারা জানান, চীন থেকে বাংলাদেশে শিল্প-কারখানাগুলোর কাঁচামালের সরবরাহ ঠিক রাখা এবং চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নির্ঝঞ্ঝাট বাস্তবায়নও বাংলাদেশের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ রিপোর্টে ‘ইতিবাচক পয়েন্ট’: সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ রিপোর্টে বাংলাদেশের জন্য অনেক ইতিবাচক পয়েন্ট রয়েছে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে মার্কিন বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই রিপোর্ট বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সচিব বলেন, তাদের মূল আগ্রহের কথা বলেছে জ্বালানি ও আইটি। আমরা মনে করি, জ্বালানিতে তাদের অনেক বিনিয়োগ আছে। পাশাপাশি আইটিতে বিনিয়োগ এলে সেটি আমাদের জন্য ভালো হবে।
তিনি বলেন, তারা যেসব চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছে, একই ধরনের কথা বিভিন্ন সময়ে জাপানি বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্য যারা বিনিয়োগ করে, তারাও বলেছে। যেসব বিষয় নিয়ে সবাই কথা বলছে সেটি নিয়ে আমাদেরও কাজ করতে হবে। সুতরাং আমেরিকানরা বলেছে বলে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো, এমন নয়।
এছাড়া, তারা যা বলেছে সেটি নতুন কিছু নয় বলেও তিনি জানান। এ সপ্তাহে মার্কিন সহকারি পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিশেল সিসন এবং কোভিড বিষয়ক উপ-সমন্বয়কারী লরা স্টোনের ঢাকা সফরের কথা রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, কোভিডের সময় অনেক বৈঠক হয়নি। জানুয়ারি থেকে অনেক বৈঠক হয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড ঢাকায় এসেছিলেন। আমরাও ওয়াশিংটনে গিয়েছিলাম বৈঠক করতে। সেটার ধারাবাহিকতায় আরও কিছু সফর হবে।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের যে সমস্যাগুলো ছিল, গত বছরের শেষে অর্থাৎ র্যাবের নিষেধাজ্ঞার পর, সেগুলো আমরা মাথায় রাখবো। কীভাবে এই আলোচনা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কাজে লাগবে, সেটি আমাদের ফোকাস থাকবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইড লাইনে মার্কিন উদ্যোগে কোভিড নিয়ে অনুষ্ঠানের বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র যদি কোভিড নিয়ে কোনও অনুষ্ঠান করতে চায় তবে অংশগ্রহণের বিষয়ে আমরা ইতিবাচকভাবে চিন্তা করবো।