×

জাতীয়

ইসির সংলাপ থেকে অর্জন কী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২২, ০৮:০৪ এএম

* বিএনপির বর্জনে গুরুত্ব হারিয়েছে * নির্বাচনকালীন সরকার ও ইভিএম প্রশ্নে দুই মেরুতে প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারা **

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপ শেষ হলো গতকাল রবিবার। এতে আমন্ত্রিত ৩৯টি দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) ২৮টি দল অংশ নিয়েছে। বিএনপিসহ ৯টি দল অংশ নেয়নি এবং দুটি দল পরে সময় চেয়েছে। আর এ ২৮টি দলের পক্ষ থেকে ৩৪০টির মত-সুপারিশ এলেও তার মধ্যে সাংবিধানিক প্রস্তাবও রয়েছে অনেকগুলো। এর মধ্যে দুটি প্রস্তাব নিয়ে প্রধান পরস্পরবিরোধী দুই রাজনৈতিক ধারার মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সমমনারা চান ৩০০ আসনে ভোট হোক ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। কিন্তু বিরোধী পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ভোটে অংশ নেবে না তারা। বিএনপি সংলাপে না গেলেও অংশ নেয়া দলগুলোর বেশিরভাগই এই দাবিটি তুলে ধরেছে ইসির সামনে। তবে ক্ষমতাসীন দল এক ফুৎকারে তা উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের একটাই কথা- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে নেই। আর সংবিধানের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সংলাপে উত্থাপিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব ইসির পক্ষে কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এই সংলাপ থেকে তেমন কোনো অর্জন হয়নি। বিএনপি অংশ না নেয়ায় সংলাপ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কেন, কী কারণে সংলাপ তা আমি বুঝলাম না। সংলাপে তো কোনো এজেন্ডা ইসি প্রকাশ করেনি। আর বিএনপি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, মাঠে তাদের প্রচুর সমর্থক। তারা না যাওয়ায় তাহলে সংলাপ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ‘২০১৪ সালের ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক নেতিবাচক সমালোচনা রয়েছে’- সিইসির এমন বক্তব্য উদ্ধৃত করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এটা খুবই সাহসী মন্তব্য। তবে যে কারণগুলোর জন্য এ দুটি নির্বাচন ভালো হয়নি, সে সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও তা থেকে উত্তরণে বর্তমান সিইসি কী করবেন এটা এখন দেখার বিষয়। তিনি সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন শুনেছি। সরকার যদি তেমনভাবে সহযোগিতা না করে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কেননা, ইসি তো একলা নির্বাচন করে না। তার সঙ্গে বহু অংশীজন যুক্ত থাকে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসনকে তিনি কীভাবে নিজের অধীনে কাজ করতে বাধ্য করবেন তা নিয়ে সবাই সন্দিহান।

সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেন, সংলাপে অনেকগুলোর প্রস্তাব সাংবিধানিক- ইসির এতে করার কিছু থাকে না। প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ দল ইভিএমে ভোট না করার প্রস্তাব দিয়েছে। পক্ষান্তরে সরকারি দল যদি ইভিএমে ভোট করার প্রস্তুতি নিয়ে ইসিকে প্রস্তাব দেয়, তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। এতে স্পষ্টতই ইসির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। কেননা, যেসব দলের অনেক বেশি ভোটার তারা যদি ভোটে না আসে তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কীভাবে হবে? তাদের মতামত নিতে হবে। বিবেচনায় আনতে হবে। তবে ইভিএম ব্যবহারের আগে এ মেশিনের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতে হবে। আবার অনেক দল ভোটের সময় সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে। তবে সেনাবাহিনীর কী ভূমিকা থাকবে তা আগে বিচার বিশ্লেষণ করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান সংলাপ থেকে প্রত্যাশিত ফল আসবে না সেটাই মোটামুটি প্রত্যাশিত ছিল। বাস্তবে তাই ঘটেছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কয়েকটি দল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছে। কেননা, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা যাবে কী যাবে না- সেটা নিয়ে তারা সন্দিহান। এটাকে যৌক্তিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। নির্বাচন কমিশন তাদের এ প্রস্তাব আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকে মোটামুটি পূর্ব নির্ধারিত এসব বিষয়ে সংবিধানের যুক্তিতে ছাড় দেয়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই, তা বলা চলে। তবে সংবিধান বা আইন এমন কোনো পাথরে খোদাই করা জিনিস নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। এটা যদি সদিচ্ছা থাকে বা রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তন করার জন্য অনুভূত হয় তাহলে কমিশন তার উদ্যোগ নিতে পারে। সংবিধানে এটা অবশ্যই পরিবর্তনযোগ্য। আমরা অন্য যে কোনো দেশের মতো সংবিধানের অপ্রয়োজনীয় ধারা পরিবর্তন করেছি এর আগে। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যেসব দল কথা বলেছে- তারাও একটা প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলেছে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার চেয়েছে। আর বিএনপি এ সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে হয়তো সংলাপে যাওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেনি। তাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কী হবে না- তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তো থেকেই যায়।

আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেছেন, সংলাপ থেকে অর্জন হচ্ছে- কোন দল কী চেয়েছে, তারা কীভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, এসব জানা সম্ভব হয়েছে। আর ইসি সংলাপ থেকে দলগুলোর মতামত জানতে পেরেছে। সেগুলো তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে জানাতেও পেরেছে, এটাও বড় অর্জন। তা না হলে সরকারকে তো জানানো যেত না- কোন দল বা কতগুলো দল কী চায়।

বিএনপি বা সমমনা দলগুলো সংলাপে আসেনি, এতে সংলাপটা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনে শেষ কথা বলে কিছু নেই। নির্বাচনের এখনো এক বছর ৫ মাস সময় বাকি রয়েছে। এ সময়ে অনেক কিছু পরিবর্তন হতে পারে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি বড় দল দই মেরুতে আছে, এখানে মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি একটা বড় ভূমিকা নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ‘আপনারা ঘেরাও করতে এলে আমরা চা খাওয়াব’। এটা কিন্তু ইতিবাচক। তিনি বলেন, আমার ধারণা সবাইকে একটা ছাড় দিতে হবে। কৌশলগত অবস্থান থেকে তারা এসব কথা বলছে। পর্দার আড়ালে কোনো এক ধরনের আলোচনার আবহ তৈরি হতে পারে। এতে বিভিন্ন পেশার মানুষ, মিডিয়া অংশ নিতে পারে। তবে তৃতীয় কোনো শক্তি যেন আবার এসে গণতান্ত্রিক পরিবেশের বাইরের কোনো অবস্থান না নিতে পারে সে বিষয়ে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। ইসি সংলাপ থেকে পাওয়া দাবি-দাওয়া বা প্রস্তাবনাগুলো দলগুলোকে এবং সরকারকে জানাবে। দেখা যাক সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তার পরে কে কতটা ছাড় দিতে পারে।

এদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা ইসির সংবিধানের সংবিধিবদ্ধ কর্তব্য। আর সেটি সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে সর্বতভাবে সহায়তা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, অতীতে অনেক নির্বাচন নিয়ে কম বেশি সমালোচনা হলেও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অতিমাত্রায় সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনাও তীব্র ও তিক্ত। আমরা নিরপেক্ষ থেকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে সমালোচনা ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে চাই। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App