×

জাতীয়

রাজস্ব আয়ের চেয়ে স্বাস্থ্য ব্যয় বেশি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২২, ০৫:৫৮ পিএম

তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো থেকে প্রতিবছর সরকারের যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে, পরোক্ষভাবে তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত লোকদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের জন্য। তামাক সেবনের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জিডিপিতেও।

মুদ্রাস্ফীতি ও মাথা পিছু আয়ের হিসেবে তুলনা করলে করলে দেখা যায়, সিগারেটের প্রকৃত মূল্য কমে গেছে। মূলত সরকারের দুর্বল কর কাঠামো ও আইন প্রয়োগের অভাবে দিন দিন বাড়ছে তামাক সেবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্যে সরকার অষ্টম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনাতেও তামাক নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু তামাক খাতের কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল, যা তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার পথে একটি বড় বাধা। এজন্য ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তামাক কর বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আইন সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

জানা যায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে করহার অপরিবর্তিত রেখে নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ এবং প্রিমিয়াম স্তর অর্থাৎ ৪ টি স্তরেই সিগারেটের দাম বাড়ানো হলেও তা জনস্বাস্থ্য রক্ষার কোনরূপ প্রভাব ফেলবে না। নিম্নস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের দাম মাত্র ১ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে যা শতকরা হিসাবে বেড়েছে ২.৫৬%, মধ্যম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ২ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা করা হয়েছে যা শতকরা হিসাবে বেড়েছে ৩.১৭% , উচ্চ স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৯ টাকা বাড়িয়ে ১১১ টাকা করা হয়েছে যা শতকরা হিসাবে বেড়েছে ৮.৮২% এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪২ টাকা করা হয়েছে যা শতকরা হিসাবে বেড়েছে ৫.১৮% হারে।

বর্তমানে সিগারেট বাজারের ৭৫ শতাংশই নিম্ন স্তরের দখলে যার প্রধান ভোক্তা মূলত দরিদ্র ও তরুণ জনগোষ্ঠী। বাজেটে বিপুল পরিমান জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। চলতি বাজেটে নিম্নস্তরে সিগারেটের দাম বেড়েছে মাত্র ২.৫৬% (প্রতি শলাকা ১০ পয়সা মাত্র)। অন্যদিকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ১০% এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬%। সে হিসেবে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় প্রকৃত অর্থে সিগারেটের দাম বিগত বছরের তুলনায় কমে গেছে। এতে সস্তা সিগারেটের ব্যবহার আশংকাজনক হারে বেড়ে যাবে। এবং তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বহুগুণে বাড়বে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সিগারেট খাত থেকে ২৪ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে এনবিআর। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, শ্বাসতন্ত্র এবং হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায় এবং মুখ গহ্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালীসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যান্সার হয়। অধূমপায়ীর তুলনায় ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ২৫ গুণ। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের আইএইচএমইর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ১ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও কয়েক লাখ। এসব ক্ষেত্রে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য খরচ তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্বের অনেক বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিম্ন্নস্তরের সিগারেটের দাম না বাড়ার কারণে সিগারেট খাত থেকে এ বছর কাক্সিক্ষত রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে নিম্নস্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের দাম ৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরেও একই দাম ছিল। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর সিগারেটের দাম বাড়ানো হলেও চলতি অর্থবছরে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়েনি, যার প্রভাব পড়ছে রাজস্ব সংগ্রহে। কারণ সিগারেটের বাজারের প্রায় ৭৫ ভাগ নিম্নস্তরের সিগারেটের দখলে। ফলে এই স্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো না হলে এ খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহ যেমন বাড়বে না, তেমনি ধূমপানও নিরুৎসাহিত হবে না।

আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের জন্য এনবিআর যে প্রাক-বাজেট আলোচনা শুরু করেছে সেখানেও নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি রাজস্ব বাড়ানোর জন্য নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো জরুরী। তারা বলছেন, সিগারেট যেহেতু রাজস্ব সংগ্রহের বড় খাত, সেহেতু যতদিন সম্ভব এ খাত থেকে বেশি রাজস্ব সংগ্রহের চেষ্টা করা। এ জন্য নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়িয়ে বেশি রাজস্ব সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ ভোরের কাগজকে বলেন, তামাক খাত থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হয় স্বাস্থ্য খাতে। একটি পরিবারের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়। আর কোন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যখন তামাকের কারণে মারা যান বা রোগাক্রান্ত হন, তখন সেই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এই ক্ষতি হিসাবের বাইরে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক ভোরের কাগজকে বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের যে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে সেটি মুদ্রাস্ফীতি ও মাথা পিছু আয়ের হিসেবে তুলনা করলে করলে দেখা যাবে যে, সিগারেটের প্রকৃত মূল্য কমে গেছে। এটি আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। এতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তামাক গ্রহণের মাত্রা কমবে না।

জানা গেছে, বাজারে অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য সিগারেট রয়েছে। বাজেটে কোন একটি স্তরের সিগারেটের দাম বাড়লে ধূমপান ছেড়ে দেয়ার বদলে ভোক্তা তুলনামূলক কম দামী সিগারেট বেছে নিতে পারছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিগারেটের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে প্রায় একই রকম রয়েছে। করের ভিত্তি এবং কর হার খুবই কম হওয়ায় বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল) অধিক সহজলভ্য থেকে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক সৈয়দ মাহবুবুল আলম ভোরের কাগজকে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণের কথা বললেই রাজস্ব আয়, সিগারেটের চোরাচালান, কর্মসংস্থানসহ নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়। অথচ তামাক থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব থেকে বেশি অর্থ ব্যয় হয় তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায়।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সিগারেটের দাম কম। ফলে প্রমাণিত হয় যে, সিগারেটের চোরাচালান মূলত কোম্পানির ভ্রান্ত প্রচারণা। এ ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো তামাকের ওপর কর বাড়ানো বাধাগ্রস্ত করে। তামাকের বড় বাজার থাকলেও স্বল্পসংখ্যক মানুষ তামাকের বিপণন, উৎপাদন ও চাষের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে তামাকের ওপর নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি তামাক কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার রোধে গণমাধ্যমকে আরও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App