×

মুক্তচিন্তা

অর্থনীতির বর্তমান সংকট কাটবে কীভাবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২২, ১২:৩৪ এএম

অর্থনীতির বর্তমান সংকট কাটবে কীভাবে?

গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো বেসামাল হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানে করোনা উত্তরণের কথা বলা হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলো এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। রপ্তানি ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচকই ভালো নেই। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্যঘাটতি এখন গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে অর্থনীতির চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে। আবার বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও সংকটে পড়েছে। ফলে সাশ্রয়ের দিকে যেতে হচ্ছে সরকারকে। একই সঙ্গে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি সরকারের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন বিশ্বেরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কোভিডের ধাক্কা অনেকটা কেটে গেলে গত জানুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হতে শুরু করলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরবরাহ সংকট এবং উৎপাদন কম থাকায় সে সময় থেকেই বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। এরপর রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। এতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে গমসহ খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমে যায়। গত জানুয়ারি থেকেই বাংলাদেশে অল্প অল্প করে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও শেষ তিন মাসে বৃদ্ধির গতি অনেকটাই বেশি। মূল্যস্ফীতি মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে টিকে থাকা কঠিন। কোভিডের মধ্যেও বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধি স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবে পরের অর্থবছরেই (২০২১-২২) প্রবৃদ্ধি হয়ে গেছে ঋণাত্মক (-১৫.১২ শতাংশ)। গত ৩০ বছরের শেষ এটাই সর্বোচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। তবে প্রবাসী আয় কমে এখন তা কোভিড-পূর্ববর্তী গড় অবস্থায় ফিরে এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, তাদের সাময়িক হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটের বর্তমান সময়ে কম রাজস্ব আদায় নিয়ে বিপাকেই পড়ে গেছে বাংলাদেশ। আয় কম বলে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে, আবার আরো মূল্যস্ফীতির আশঙ্কায় জ্বালানির দামও বাড়াতে পারছে না। একই সঙ্গে সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পেও বরাদ্দ কমাতে হচ্ছে। সরকার এখন মূলত জ্বালানি চাহিদা কমবে, এ অপেক্ষাতেই আছে। এ ক্ষেত্রে ভরসা হচ্ছে আগামী শীত, বেশি বৃষ্টি এবং বিশ্ববাজারে দর হ্রাস। বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগত মন্দার ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছে। অর্থনীতির জন্য সামনের সময় আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন। চলতি ২০২২ সাল কঠিন যাবে, সামনের ২০২৩ সাল হবে আরো কঠিন। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। মন্দা দেখা দিলে রপ্তানি আয় নিয়ে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। প্রবাসী আয়ও আরো কমবে। সুতরাং এক বিপদ থেকে রক্ষা পেলেও পড়তে হবে আরেক বিপদে। সুতরাং অর্থনীতির ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা সহজে কাটবে না। বৈদেশিক মুদ্রায় এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। আর এতেই চাপ তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। কারণ জ্বালানি, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ আছে ৩১ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার প্রভাব পড়েছে ডলারের বাজারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। বেশি দাম দিয়েও খুচরা বাজারে আগের মতো বড় অঙ্কের ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের অর্থনৈতিক সংকটে নড়ে-চড়ে বসেছে সরকারও। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলসহ নানা ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও চাপের মুখে পড়েছে। জ্বালানিসাশ্রয়ী নীতিতে হাঁটতে গিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে এনেছে সরকার। সারাদেশে লোডশেডিংয়ের সিডিউল করে দেয়ার মতো কঠোর নীতিও চালু করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে চাপে পড়েছে দেশের শিল্পোৎপাদন। এরই মধ্যে শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাতে শুরু করেছেন। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভুল নীতির কারণে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে যে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। বরং আগামীতে এ পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণসহায়তা নেয়ার আলোচনা উঠেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অবশেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়েছে। এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করতে আইএমএফকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে ঋণের অঙ্ক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ৩ বছরের জন্য চায় ৪৫০ কোটি ডলার। শুধু আইএমএফ নয়; বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার কাছ থেকেও বাজেট সহায়তা নেয়ার আলোচনা চলছে। এডিবির সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের বাজেট-সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার- এই দুই খাতে অর্থ খরচ করতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের জন্য দুই মাস আগেই এডিবির কাছে সহায়তা চেয়েছে সরকার। তবে কিছু শর্ত নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অর্থ প্রদান সহজ করা, প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা, অর্থ খরচে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে কর দেয়ার ব্যবস্থা সহজ করা; আয়কর ও শুল্ক নিয়ে নতুন দুটি আইন চালু এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে সহায়তা দেয়া। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৭০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। জাইকার কাছেও বাজেট সহায়তা চেয়ে অনুরোধ করার ব্যাপারে কাজ চলছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। ৫-৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেলে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি থাকবে না। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা ভালো। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাতা সংস্থাগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কঠিন কোনো শর্ত দেয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থনীতির সামগ্রিক দিক পর্যালোচনা করলে আমরা বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় অনেক ভালো আছি। এ কারণে বড় কোনো সংকটের শঙ্কা নেই। তবে সরকারের ব্যবস্থাপনা আরো সুষ্ঠু হতে হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে যে সংকট চলছে, সেটি রেকর্ড পণ্য আমদানি ও বিশ্ববাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফল। মহামারির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমদানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের পরিমাণ না বাড়লেও মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আশার কথা হলো, আমাদের রপ্তানি আয়ও প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরও বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়াটি শঙ্কার। বৈদেশিক বাণিজ্যে নিয়ে দেশে যা কিছু হচ্ছে সবই ভুল নীতির খেসারত। যে মাত্রার সামঞ্জস্যহীনতা তৈরি হয়েছে, সেটি শিগগিরই কাটিয়ে ওঠা কঠিন। বহু আগে থেকেই দেশের অর্থনীতিবিদরা আমদানির ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেখব, দেখছি বলে সময়ক্ষেপণ করেছে। এ কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে যে সংকট সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেই। শুধু রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সংকটের তুলনায় সেসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের ছিদ্রগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ভুল নীতির ফল। আগামীতে এ সংকট আরো গভীর হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App