×

মুক্তচিন্তা

ওই অজগর আসছে ধেয়ে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২২, ০১:৫১ এএম

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে আরো বলবান, আরো আগ্রাসী এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে বাংলা ভাষাকে আরো বিচ্ছিন্ন করে বাঙালির ভাবাবেগকে খণ্ডিত-দ্বিখণ্ডিত করে সাম্প্রদায়িকতার বৃক্ষরোপণকে ছড়িয়ে দিতে, কতিপয় ভাগ্যবানের সৌভাগ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ভারত এবং বাংলাদেশে একটি দল মরিয়া হয়ে কাজ করছে। এসব দেখে কখনো কখনো আচমকা আমাদের শিহরণ বেড়ে যায়, আমাদের জাগৃতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু তা কেবল সামান্যতম সময়ের জন্য। তারপরই আমাদের পক্ষ থেকে স্তব্ধতা আর নিম্প্রভ ভাবাবেগ! ভাষার ওপর এবং বাঙালিয়ানার অস্তিত্বের ওপর বহিরাঘাত তাৎক্ষণিক যৎকিঞ্চিৎ প্রতিবাদ জাগিয়ে তুললেও তা একসময় স্তব্ধতার সাগরে বিলীন হয়ে পড়ে। একসময় আমরা তা বরণ করে নিই। রুগ্ন জাতির লক্ষণ, সন্দেহ নেই। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে, ’৬৯-এর গণআন্দোলন নিয়ে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্বিত স্মৃতিদীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য এমন সতর্ক-অসতর্ক নীরবতার চেহারা বড়ই আশ্চর্যের! ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্য তো এটি আরো বেশি বেদনার চিত্র। পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববঙ্গীয় ঐতিহ্যের স্বপ্ন লালন করে আসছে সেই কবে থেকে- ভারতের স্বাধীনতার দিন থেকেই। কিন্তু মোদির ভারত সে কথা শুনবে কেন? ইতোমধ্যেই অযোধ্যায় বাবরকে সরিয়ে দেয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে এখন রামমন্দির। নতুন আর এক মামলা। নতুন মামলাটির ভরকেন্দ্র বারানসি- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচন কেন্দ্র। সেই বারানসি, যেখানে অবস্থিত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও তার লাগোয়া জ্ঞানবাপী মসজিদ। মামলা হয় জ্ঞানবাপী মসজিদে বছরভর পূজা করার অধিকারের দাবিতে। ঘরপোড়া গরুদের হালের মতো অবস্থা হলো; সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে রইল মামলাটি। তবে এ যাত্রায় অন্তত বেঁচে গেলেন সম্রাট শাহজাহান। তাজমহল আপাতত রেহাই পেল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষেèৗ বেঞ্চের দুই বিচারপতির রিভিশন বেঞ্চের দূরদর্শিতায় তাজমহল ‘তেজো মহালয়’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আপাতত এড়াতে পারল। আপাতত বলছি এ কারণে যে, ভারতে মোদি জামানায় ইতিহাস নিত্য প্রহেলিকাময়। কবে কোন আদিখ্যেতায়, ক’দিন বাদে কোন ভীমরতিতে কিংবা হঠাৎ চাগাড় দিয়ে ওঠা কোনো এক সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়িতে এ ঐতিহাসিক সৌধটি সরকারি বুলডোজার কিংবা উন্মত্ত হিন্দুত্বের শাবলের মুখে পড়বে, তা নিশ্চিতভাবে বলার কোনো উপায় নেই। কারণ ভারতের নানা আদালতে রজনীশ সিংয়ের মতো ব্যক্তিদের করা একাধিক পিটিশন বিচারাধীন অবস্থায় টিকে আছে। সেগুলোর সবকটাতেই আর্জি অভিন্ন। বক্তব্য পরিষ্কার- তাজমহল আসলে হিন্দু মন্দির ‘তেজো মহালয়’। ১২১২ সালে জনৈক হিন্দু রাজার তৈরি শিবমন্দির এটি। সেই মন্দির ধ্বংস করে মোগল সম্রাট শাহজাহান সপ্তদশ শতাব্দীতে তাজমহল নির্মাণ করেন। সুতরাং বাবরি মসজিদের মতো তাজমহলও গুঁড়িয়ে দিয়ে হিন্দু মন্দির পুনঃনির্মিত হতে হবে। এ দাবির পালে বাতাস আনতে আবেদনকারীরা আর্জি জানিয়েছিলেন, তাজমহলের মাটির নিচে ২২টি ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। তাজমহলের ভিত কতটা শক্তপোক্ত, সেটা বুঝতে পুরাতত্ত্ববিদদের একাধিকবার ঢুঁ মারতে হয়েছে ওই ভূগর্ভস্থ ঘরগুলোতে। তখনই দেখা গিয়েছে, তাজমহলের মতো বিশালাকৃতির স্থাপনা নির্মাণের জন্য এবং মিনার বা সমাধির ভার বহনের জন্য যে রকম ভিত দরকার, এটা সে রকম একটা ভিত। সেই ভিতের প্রয়োজনেই ২২টি কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই ঘরগুলোতে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো কিছু নেই। তাই তাজমহলের ওই অংশটা যাতে ভিড়মুক্ত থাকে এবং মানুষের অহেতুক পদচারণায় যাতে সংরক্ষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্যই ওই অংশটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্লেষণ, আইন, ইতিহাস যে কথাই বলুক- ভয় হলো, বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। জানা হয়ে গিয়েছে, বিচার-বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু একবার শাবল-কোদাল দিয়ে পুরনো নির্মাণ ভেঙে ফেলতে পারলেই কেল্লাফতে! তখন পছন্দমতো নতুন নির্মাণে আপত্তি করতেও ইতস্তত করেন আদালত। অযৌক্তিক-অনৈতিহাসিক ইচ্ছাও তখন অনেক সময় আইনি বৈধতা পেয়ে যায়। কারণ এতদিনে আমরা এ-ও বুঝে গিয়েছি, মনের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। ভারতের গর্বিত ‘হিন্দু জনতা’ আর বাংলাদেশের ‘ইসলামী তৌহিদী জনতা’র মাঝপথে অসাম্প্রদায়িক হিন্দু আর মুসলিম জনগোষ্ঠী আজ যেন দিশাহারা আর বেকায়দায় পড়ে গেছে। এসব দেখে কারো কারো রাগ হওয়ারই কথা; বিপন্ন বোধ করাই স্বাভাবিক। বিস্মিত হওয়ার মতো অনেক পরিস্থিতিই তৈরি হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। এখন এসব ছাপিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটু একটু ভয় হচ্ছে। একদিকে সাধারণ মানুষ জিনিসপত্রের দাম নিয়ে দিশাহারা; বেকারত্ব রেকর্ড সৃষ্টির পথে। আগের মতো রোজগার নেই; সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তার ওপর এ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প সাধারণ মানুষকে একেবারে যেন লণ্ডভণ্ড করে তুলছে। কিন্তু সমস্যা হলো, রাষ্ট্র ঘুমিয়ে আছে। রাষ্ট্র এ সাম্প্রদায়িক চেতনাকে স্বীকৃতি দিতেও ভয় পায়, আবার অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশেও সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। রাষ্ট্র তার মস্তিষ্কহীন অনুগত বাহিনীর মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যে নানারকম বিভাজনের বীজ বপন করে যাচ্ছে, তা যেন ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ ঠিকই ধুঁকে ধুঁকে ভুগছে এ বিষক্রিয়ায়। ২০-৩০ বছর একসঙ্গে পাশাপাশি বড় হয়ে হঠাৎ কোনো এক সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি আর ব্যাখ্যার জোরে একে অপরকে শত্রæ ভাবতে শুরু করেছে। রাষ্ট্র আসলে এসব দেখেও দেখে না। সম্ভবত কিছু গোপন করতে চায় রাষ্ট্র। আর এ সুযোগে মৌলবাদী গোষ্ঠী দেশবাসীর চিন্তাকে ডাইভার্ট করে দিতে চায়। তারা চায়, আইডেন্টিটি নিয়ে মানুষ যেন নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি, মারামারি, সংঘর্ষ ও সংঘাতে লিপ্ত থাকে। তাই আজ এ হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান আইডেন্টিটি নিয়ে বিভাজন ও অশান্তি বেড়েই চলেছে। আর এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই মোদির বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতের মতো বহুত্ববাদী দেশেও সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে। আমরাও কোনো না কোনো পক্ষ নিয়ে এসব সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির সুবিধা করে দিচ্ছি। আমাদের বুদ্ধিহীনতায় এসব সাম্প্রদায়িক শক্তির সুবিধা ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। আর আমাদের জন্য বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। সব কিছু বুঝেও চুপ করে আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যার সোচ্চার থাকার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, সেই সাংবাদিক সমাজও। সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা সাংবাদিকরা মধ্যবিত্ত পরিবার আর সামান্য চাকরি নিয়ে বেঁচে থাকে সব দেশেই। শাসক কিংবা সাম্প্রদায়িক শক্তির পাহাড়প্রমাণ চাপ নেয়ার মতো ক্ষমতা খুব বেশি সাংবাদিকের থাকে না। লাগাতার আঘাতে, অন্যায় প্রলোভনে কেউ কেউ ভেঙে পড়ে; কেউ কেউ জলাঞ্জলি দেয় আদর্শকে। মিশে যায় আর দশটা সমাজের মানুষের মতো সোজা পথে, পিচ্ছিল পথে। মেনে নেয় স্বাধীনতাহীনতাই এ যুগের সংবাদমাধ্যমের নিয়তি বলে। ভারত এবং বাংলাদেশের মূল সুর- বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়া। অর্থাৎ ঐক্যের শর্ত হলো ঐতিহাসিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করা। কেননা এ দেশগুলো বহুজাতিক দেশ। এটাই এ দেশের ভাষার সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ। এটাই এদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে হাতিয়ার করার মন্ত্র। উগ্র জাতীয়তাবাদ আর জাতিসত্তার নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান। এটাই আমাদের বহু ধর্মীয়, বহু পরিচিতির মিলন কৌশল- যা বরাবরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুদৃঢ় এবং সুচিন্তিতভাবে। আমরা যেহেতু সব মানুষের জন্য ন্যায়সঙ্গত সমাজের স্বপ্ন দেখি, তাই এ উপরি কাঠামোর বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যেতে পারি না। এ উপরি কাঠামোর গঠনই আমাদের মৌলিক কাঠামোর সুর। এ সুরই আমাদের প্রস্তুত করেছে ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে সক্ষম জাতি হিসেবে। কেননা এটাই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি হিসেবে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষকে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক হতেই হবে। কিন্তু তার জাতি সংস্কৃতির উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যগুলোকে আগেই শিকড়ে গেঁথে নিতে হবে। অসাধারণ বলেছিলেন ভারতের বাঙালি গুরুদাস দত্ত- ‘বিশ্ব মানব হবি যদি, কায়মনে বাঙালি হ’। কিন্তু কোথায় যেন আজো ‘কিন্তু’ রয়েই গেল! সেই কবে ভাষা মতিনের আক্ষেপ প্রকাশিত হয়েছিল, আজো বাতাসে তারই গন্ধ জোরেশোরে বইছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আব্দুল মতিন। যাকে সবাই চেনেন ‘ভাষা মতিন’ হিসেবেই। আজীবন সংগ্রামী এ মানুষটি জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ‘জাতি কাকে বলে সেটা এ উপমহাদেশের মানুষ জানে না, জানলে তাদের হাতেই অন্যরকম উপমহাদেশ তৈরি হতো।’ অন্যরকম উপমহাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। ভারত এগিয়ে যাচ্ছে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানপন্থিদের হাতে; বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে ইসলামিক মৌলবাদীদের হাতে। উপমহাদেশের সর্বত্র আজ তাই ধেয়ে আসছে কালো ধোঁয়া। আমাদের সময় এসেছে, ঐক্যের ঐতিহ্যের ধারক বাংলাদেশকে বিভক্তির রাজনীতি আর সমাজনীতির হাত থেকে রক্ষা করার। একই ঐতিহ্যের বাহক এবং একুশের ভাষা আন্দোলনে উদ্দীপ্ত-সচকিত এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার যোদ্ধাদের সে সময়ের বিসর্জনের ইতিকথা জোরেশোরে আজ প্রকাশ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন তাকে নিয়ে উৎসব করা; প্রয়োজন তার সামাজিক চর্চা। নইলে আমাদের অপূর্ণতা, রুগ্নতা বাড়বে; বাড়বে উসকানিপ্রবণ কবন্ধের অনুপ্রবেশ। আর তখনই তাদের হাতে দেশের গণতন্ত্রের উদার সুষমার বহুমাত্রিক সূত্র অবজ্ঞা পেয়ে স্থান লাভ করবে যুক্তিহীন, ক্ষমতামত্ত আগাছা। তারা তখন বিপুল উৎসাহে আরো বেশি ডালপালা ছড়াতে অতি উৎসাহী হয়ে উঠবে। তাদের এক দেশ এবং এক ধর্মানুভূতি আধুনিক মানুষের ভাবনা-চিন্তা, দেশপ্রেম ও বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষতাকে খুশি রাখতে পারে না। তাই প্রতিবাদ বাঙালিকে করতেই হবে। না হলে তাকে মরতে হবে লজ্জা আর আত্মপীড়নে। কারণ একপেশে, সংস্কৃতিশুষ্ক ভূখণ্ডের স্বপ্ন তাদের ছিল না; আমাদের ঐতিহ্যও তা কখনো চায়নি। সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App