×

অর্থনীতি

তিন কারণে চড়ছে ডলার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২, ০৭:৪৮ এএম

# বৈশ্বিক অস্থিরতা, মজুতদারি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের ফারাক অস্বাভাবিক

অস্বাভাবিক গতিতে বেড়েই চলেছে ডলারের চাহিদা। বাড়তি চাহিদার কারণে দেশের খোলাবাজারে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ৫০ লাখ ৪০ হাজার ডলার বাজারে ছেড়েছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ছয় মাসে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। এছাড়া আমদানি কমাতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে ডলারের। এরপরও যেন কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না ডলারের তেজিভাব। এতে যাদের জরুরিভাবে ডলার প্রয়োজন তারা চাপে পড়েছেন। যদিও ইতোমধ্যে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদারকি শুরু করেছে। এতে গত দুই দিনে খোলাবাজারে কিছুটা কমেছে ডলারের দাম। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সাময়িকভাবে সমস্যা মোকাবিলা করা গেলেও স্থায়ীভাবে সম্ভব নয়। এজন্য আন্তঃব্যাংক মার্কেটকে সচল করার প্রতি গুরুত্ব দেন তারা। সংশ্লিষ্টদের মতে, নিত্যপণ্যের বাজারের মতো এখন ডলারের বাজারেও অতি মুনাফার লোভে মজুত করেছে কিছু অসাধু মানুষ। এছাড়া হঠাৎ এত ডলারের চাহিদা বাড়ার কোনো কারণ নেই। এরপরও যেহেতু বাড়ছে, তাই এখানে অর্থ পাচার বা কোনো কারসাজি হচ্ছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি এ বিষয়ে এখনই জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন তারা।

জানা গেছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে অস্থির বিশ্ব অর্থনীতি। এতে বাড়তি আমদানি খরচ মেটানো ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরের বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলার। গত দুই-তিন মাসে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দর ছিল ৯৪ দশমিক ৭০ টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবারও এ দাম ছিল। তবে খোলাবাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকও বাড়তি দামে ডলার বিক্রি করছে। ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে ১০৮ থেকে ১১০ টাকায়। অনেকেরই অভিযোগ, ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো দামে নগদ ডলার বিক্রি করছে। ক্রেতাদের সবাই বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা, সভা-সেমিনারে অংশ নিতে ডলার কিনছেন, তেমন নয়। ব্যাংকিং খাতে কড়াকড়ির কারণে একশ্রেণির ব্যক্তি ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ ডলার কিনছেন। আরেক শ্রেণি শেয়ারবাজারের মতো ডলারে বিনিয়োগ করছে। সঞ্চয়পত্রে কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে কেউ কেউ দুর্নীতির টাকায় ডলার কিনে রাখছেন। ডলার পাচারও হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খোলাবাজারে গেল কয়েক দিনে বেশ বড় অঙ্কের ডলার কেনার চাহিদা এসেছে, যা মানুষের ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের স্বাভাবিক চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। পাচারের বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে কিছু মানুষ ডলার মজুত করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

বাজারে ডলারের দাম প্রথমবারের মতো ১০০ টাকার ঘর পেরিয়ে যায় গত ১৭ মে। এরপর আবার কমে আসে। গত ১৭ আগস্ট ফের ১০০ টাকা অতিক্রম করে। এ বিষয়ে মানিচেঞ্জার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এ কে এম ইসমাইল হক জানান, গত কয়েক দিন ডলারের ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। ১১৫ টাকা পর্যন্ত ডলার বিক্রি হয়েছে। এভাবে দর কেন বাড়ছে- তার সুনির্দিষ্ট কারণ তাদের জানা নেই। তবে দর আরো বাড়বে ভেবে অনেকে হয়তো ডলার মজুত করে রাখছেন। পাচার বা অন্য কিছু ঘটছে কিনা, সে বিষয়ে ধারণা নেই বলে জানালেন এই মুদ্রা ব্যবসায়ী।

দেশে অনুমোদিত মানিচেঞ্জার ৬০২টি, এর মধ্যে ২৩৫টির বৈধতা আছে। বাকিগুলোর লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল রয়েছে। মানিচেঞ্জারের দৈনন্দিন কেনাবেচার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হয়। তবে অনেক মানিচেঞ্জার এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকে, যারা প্রতিষ্ঠানের বাইরে গ্রাহকের কাছ থেকে ডলার কেনাবেচা করে। এ ধরনের লেনদেন অবৈধ। লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল হওয়া কিছু মানিচেঞ্জার ডলারের অবৈধ ব্যবসায় নেমেছে। মানিচেঞ্জারের বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ের অবৈধ লেনদেনে কোনো কাগজপত্র লাগে না।

জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআইআর) রিপোর্টের বরাত দিয়ে আমরা প্রায় ১০ বছর ধরেই এ বিষয়ে বলছি- অর্থ পাচার হচ্ছে। জিএফআইআর এর রিপোর্টে সবশেষ ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিনিয়ত এ অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। তারা তো সব হিসাব নিতে পারে না, তাই আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৮২ শতাংশ অর্থ পাচার হচ্ছে, বলছে রিপোর্ট। তিনি আরো বলেন, সাধারণত সংকটের সময় কিছু মানুষের মধ্যে কোনো কিছু বেশি করে কিনে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। ডলারের খোলাবাজারে এমনটি ঘটতে পারে। এ গবেষক বলেন, নির্বাচনের আগে অর্থ পাচার বাড়ে বলে ধারণা করা হয়। ডলার পাচার হচ্ছে কিনা, তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো খতিয়ে দেখতে পারে। আমদানি ও রপ্তানির মূল্য কম-বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের প্রবণতা বিশ্বজুড়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এখন খোলাবাজারে ডলারের দরের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পাচারের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই এখনই সময় এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স এবং খবরদারি, নজরদারি বাড়ানো।

ডলার বাজারের অস্থিরতা নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম আর এফ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, সারা বিশ্বেই অস্থিরতা চলছে। আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। যে পণ্য গত বছর ১০০ ডলারে আমদানি করেছি, সে পণ্য এখন ১৪০ ডলারে কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমদানিতে উচ্চ ব্যয়, তেল, গ্যাসের উচ্চমূল্য, করোনা পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস, একই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আর এফ হোসেন বলেন, সার্বিক পরিস্থিতিতে একচেঞ্জ রেট উপরে উঠবেই। প্রতি মাসে আড়াই বিলিয়ন লেনদেন পার্থক্য। আগামী ৬ মাসের মধ্যে রেমিট্যান্স বা রপ্তানি বাড়বে- এ কথা বলা যায় না। তার মানে, এ পার্থক্য অনেকটা দীর্ঘস্থায়ী। আস্তে আস্তে হয়তো কমে আসবে। তবে সারা বিশ্বে যেখানে অন্য মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, আমাদের দেশেও তাই হবে- এটাই স্বাভাবিক। এটাই অর্থনীতির প্রবণতা।

ডলারের মাধ্যমে অর্থ পাচার কীভাবে হয় : নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট খাতের একজন বিশ্লেষক জানান, নির্বাচন সামনে রেখে দেশ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে কাগুজে ডলার পাচার হচ্ছে। আগে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচার হলেও বর্তমানে এসব খাতে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। ফলে ডলার নিয়ে চলে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি প্রতি বছর বিজনেস ট্যুরের ব্যবস্থা করে। কতজন ট্যুরে যাবেন তা বিজনেস ট্যুর অপারেটরদের জানানো হয়। বৈধভাবে একজন ব্যক্তি ৫ হাজার ডলার সঙ্গে নিতে পারেন। কিন্তু দেখা গেছে, মনিটরিং কম থাকার কারণে এয়ারপোর্ট থেকে একজন ১০ হাজার ডলারও বহন করেন। এছাড়া কার্ডের মাধ্যমে এবং কাগুজে নোট নেয়ার কারণেও ছাড় পেয়ে যান। কোনো প্রতিষ্ঠানের এসব ট্যুরে ৩০ জন থাকলে বৈধভাবেই তারা ৩ লাখ ডলার বা ৩ কোটি টাকা নিয়ে যেতে পারছে। তিনি আরো বলেন, এখন কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন সুবিধা হওয়ার কারণে যারা বিদেশে যায় তারা ডলার কাগজে নেয় না, ডুয়েল কারেন্সি কার্ডের মাধ্যমে নেয়। কাগজের ডলারের সংকট এবার এ কারণে হয়েছে, ট্যুর বা নানা মাধ্যমে বেশ কিছু কাগুজে ডলার চলে গেছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, ব্যাংকের আমানতে সুদহার কম এবং পুঁজিবাজারে অস্থির অবস্থার কারণে ডলারের দাম বাড়বে মনে করে অনেকেই মজুতের দিকে ঝুঁকেছেন। অথচ ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট অনুযায়ী কেউ এ পরিমাণ ডলার মজুত করতে পারবে না। একজন ব্যক্তি যে পরিমাণ ডলার বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে, সে ঠিক ওই পরিমাণ ডলার তার সংগ্রহে রাখতে পারবে।

এ সূত্র আরো জানায়, ডলারের সংকট থাকার কারণে ঈদের আগে দুবাই এবং থাইল্যান্ড থেকে বেশকিছু ডলার দেশে চলে এসেছিল। কিন্তু সামনে নির্বাচন তাই ব্যাংকেও টাকা রাখছে কম। আবার ডলার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এতে সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App