×

মুক্তচিন্তা

আইসিজেতে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ, এতে রোহিঙ্গাদের কী লাভ?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২, ১২:২৩ এএম

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা সংক্ষেপে আইসিজে) গাম্বিয়ার করা চলমান মামলার বিরুদ্ধে মিয়ানমার যেসব আপত্তি দিয়েছিল, আইসিজে সেটা গত ২২ জুলাই খারিজ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের আপত্তিগুলো ছিল : (১) গাম্বিয়া রোহিঙ্গা সংকট বা সমস্যার কোনো পার্টি নয়, সুতরাং গাম্বিয়া রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মামলা করতে পারে না। তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের কারণ গাম্বিয়া কোনো ক্ষতিগ্রস্ত দেশ নয়। সুতরাং গাম্বিয়ার মামলা করার কোনো সুযোগ নেই; (২) আইসিজেতে মামলা করতে পারে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্র, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন নয়। কিন্তু গাম্বিয়া মামলা করেছে অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স বা ওআইসির পক্ষে। সুতরাং এ মামলা আইসিজেতে চলতে পারে না কারণ একটা পদ্ধতিগতভাবে এ মামলা দাখিলে ত্রæটি আছে, (৩) গাম্বিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের কোনো বিরোধ নেই। কোনো ধরনের আইনি জটিলতা বা দ্ব›দ্ব নেই। সুতরাং আইসিজেতে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই; (৪) মিয়ানমার জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ১৯৪৮-এর জেনোসাইড কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদ স্বাক্ষর করেনি। তাই আইসিজের কোনো আইনি এখতিয়ার নেই মিয়ানমারের বিচার করার। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গাম্বিয়ার আইসিজেতে মামলা করে ২০১৯ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সে মামলার শুনানি হয়; সেখানে তৎকালীন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলের উপদেষ্টা অং সান সু কির নেতৃত্বে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয় এবং মিয়ানমারের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। তখন গাম্বিয়ার মামলা করার সুযোগ আছে কিনা সে আলোচনা হলেও কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আইসিজের এখতিয়ার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। বরং সু কির নেতৃত্বে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের অফিসিয়াল হিয়ারিংয়ের কারণে গাম্বিয়ার করা এ মামলা যে মিয়ানমার আমলে নিয়েছে, সেটাই প্রকারান্তরে প্রতিভাত হয়েছে। বিপত্তি ঘটে তখন যখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার ২০ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের জান্তা সরকার আইসিজেতে এ চার দফা আপত্তি দাখিল করে। কিন্তু এ আপত্তির ওপর দীর্ঘ শুনানির পর গত ২০ জুলাই আইসিজে প্রায় ৯ হাজার পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ রায় দেয়। এবং মিয়ানমারের এসব আপত্তি খারিজ করে দিয়ে আইসিজে বলেছে, গাম্বিয়া মামলা করতে পারে। আইসিজের জুরিসডিকশনের মধ্যে গাম্বিয়ার মামলা করার সুযোগ আছে। আর মিয়ানমার ১৯৪৮ এর জেনোসাইড কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং জাতিসংঘের আদালতে (আইসিজেকে জাতিসংঘের ‘বিশ্ব আদালত’ বলা হয়) জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত যে কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার হতে পারে। এটাকে অনেকে একটা বড় ধরনের বিজয় হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এটাকে একটা বড় বিজয় হিসেবে উল্লেখ করে ‘বাহবা’ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় রোহিঙ্গা ডাইয়াসপোরা একটিভিস্টরাও এটাকে তাদের একটা বড় বিজয় হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশেও এ রায়কে নিয়ে নানা মহলে উচ্ছ¡াস লক্ষ করা যাচ্ছে। এ রায়ের ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটনের যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেটার বিচারকার্য পরিচালনায় আর কোনো বাধা থাকল না। অর্থাৎ এ বিচারিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং মিয়ানমারকে এ বিচার কাজে অংশ নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আইসিজেতে মিয়ানমার কর্তৃক সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার হলে রোহিঙ্গাদের কী লাভ? বিশেষ করে, বাংলাদেশের কী লাভ? আমি রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে গবেষণার কাজ করি। রোহিঙ্গা সংক্রান্ত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানান ইস্যুর খোঁজখবর রাখি এবং অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে সেটার বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার কেন্দ্রীয় মনোযোগ হচ্ছে, এসব বিচার-টিচার দিয়ে বাংলাদেশের কী লাভ? বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কী লাভ? ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসার পর থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফে বসবাস করছে। আজ প্রায় ৫ বছর হতে চলল, কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সমাধান নেই। বাংলাদেশ দুইবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ এবং ২০১৯ সালের আগস্টের ২২ তারিখ দুই দফা প্রত্যাবাসন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে প্রধানত মিয়ানমারের অনাগ্রহ এবং অসযোগিতার কারণে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও পরোক্ষভাবে তীব্র বিরোধিতা করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমরা এরপর থেকে আর দেখিনি। এদিকে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রতি বছর ৩৫ হাজার করে নতুন করে রোহিঙ্গার জন্ম দিচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা জনসংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। এটা এখন প্রায় ১২ লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য তার সাধ্যমতো যটটুকু করার করছে। এরই মধ্যে ভাসানচরে পরিকল্পিত এবং প্রস্তাবিত এক লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র ২৮ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করানো হয়েছে; কিন্তু সেটাও রোহিঙ্গা সমস্যার যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করবে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যার আশু কোনো সমাধান আমরা দেখতে পারছি না। এ রকম পরিস্থিতিতে আইসিজেতে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ হওয়ায় বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না। কেননা এখন মামলা যদি চলেও তাও একটা চূড়ান্ত রায় পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এমনকি ৫ বা ১০ বছরও লাগতে পারে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নেই যে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ হলো এবং মিয়ানমার জেনোসাইড সংঘটনকারী রাষ্ট্র হিসেবে সাব্যস্ত হলো। তাহলে কী হবে? আইসিজের নিজের কোনো ক্ষমতা নেই কোনো রাষ্ট্রকে শাস্তি দিয়ে এবং সে শাস্তি প্রয়োগ করা বা বাস্তবায়ন করা। আইসিজের রায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্যদের ফোরামে সেটা উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু আমরা জানি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ফোরামে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, কারণ যে কোনো একটি রাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করলে আর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন সবসময় মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সুতরাং এটা ধরেই নেয়া যায় যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ফোরামে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে সম্ভব হবে না। তারপরও আইসিজের রায়ের একটা আন্তর্জাতিক প্রভাব আছে সেটা অনস্বীকার্য। যদি রায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে এটা সত্য যে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমার নানারকম রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়বে। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করে দেবে। তাই আমার মনে হয় না, আইসিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ হয়ে গেলেও অর্থাৎ আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত জেনোসাইডের অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও বাংলাদেশের আখেরে বড় ধরনের কোনো লাভ আছে। এটা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানেও তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না। এমনকি বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের জীবনেও এটার কোনো সুদূরপ্রসারি লাভ নেই। অতএব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিয়ানমারের বিচার প্রক্রিয়া কোন দিকে যাচ্ছে, তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দিকে মনোযোগ দেয়া। এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পলিসির সপক্ষে দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সম্প্রতি রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য যে বিশাল সমাবেশ করে নিজের ইচ্ছা এবং আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কেননা ইজ্জতের সঙ্গে এবং নিরাপত্তার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মধ্যেই রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি এবং বাস্তবসম্মত সমাধান নিহিত।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App