×

মুক্তচিন্তা

শতবর্ষ পরেও দীপ্তিমান লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২২, ০২:০০ এএম

শতবর্ষ পরেও দীপ্তিমান লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়
সময়ের পরিক্রমায় বদলে যায় অনেক কিছু। যোজন-বিয়োজনের ধারাপাতে এই অদল-বদলই যেন নিত্য বাস্তবতা। চলমান স্বাভাবিকতার ঘাত-প্রতিঘাতে কোনো কিছু যেমন অতল তলে হারিয়ে যায় আবার কোনো কিছু রঙিন আলোকছটার পরশে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে অহরহ। এসব কথা একদিকে যেমন ব্যক্তিজীবনে সত্য অন্যদিকে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তেমনি একটি সুপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯২০ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রাচীন বিদ্যাপীঠ যে প্রজ্বলিত আলোর মশালে আলোকিত করেছিল অবহেলিত এই জনপদের পথ-প্রান্তর, সেই আলোকছটার তেজ এতটুকুও কমেনি আজ অবধি। বরং শতবর্ষ পরেও দীপ্তিময় বাতিঘরের মতো প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত ও উদ্ভাসিত হয়ে প্রাণিত করেছে হাজার-হাজার শিক্ষার্থীর মন ও মনন, গড়ে দিয়েছে ভূত-ভবিষ্যৎ, রণনে-অনুরণনে উদ্দীপ্ত করেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রগতির সড়কে এবং স্ব-উৎসারিত আলোকধারায় দৃশ্যমান আলোকবর্তিকার মতো বারবার জানান দিয়েছে নিজের সাফল্যমণ্ডিত অস্তিত্ব। এই হলো আমাদের প্রাণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। গেল ২০২০ সালে শতবর্ষ পার করে আবার শতায়ুর পথে যাত্রা শুরু করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তদানীন্তন বালিয়াডাঙ্গী-লাহিড়ী জনপদে তেমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করার জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ছুটতে হতো ঠাকুরগাঁও শহরে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে। ফলে দেখা যেত শুধু সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তানরাই এই সুযোগ পেত; কিন্তু অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রাথমিক স্তরেই শিক্ষাজীবন শেষ করত। এসব মানবিক দিক ও এলাকার শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নতির কথা বিবেচনা করে লাহিড়ী ও তৎসংলগ্ন এলাকার কিছু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন লাহিড়ী এম ই স্কুল। পরে দেশভাগের পর এটি এম ই থেকে নি¤œ-মাধ্যমিক এবং পরবর্তীতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে রূপ লাভ করে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পরবর্তী বিভিন্ন ধাপে যারা নানাভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন তাদের মধ্যে বাবু শ্যামাপ্রসাদ রায়, মৌলভী তমিজউদ্দিন আহাম্মেদ, ভবানীচরণ চ্যাটার্জী, ভবেশচন্দ্র সিংহ, ডা. দেরেম আলী, ডা. ইদ্রিস আলী, ডা. ওসমান গণি ও নাজমুল হকের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই লেখা লিখতে গিয়ে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই প্রয়াত প্রধান শিক্ষক হেরাসউদ্দিন আহমেদ স্যারের কথা। অসম্ভব প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা আর ভীষণ রাশভারী এই মানুষটি ছিলেন অসীম জ্ঞানের অধিকারী। শুধু স্কুলের চৌহদ্দিতেই নয়, বরং তার প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছিল জেলার সর্বত্র। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। লাহিড়ী স্কুলের যে বর্তমান কলেবর, যে অবস্থান ও সুনাম- সেই কৃতিত্বের অন্যতম অংশীদার হলেন হেরাসউদ্দিন আহমেদ স্যার, এ কথা জোর দিয়েই বলতে হবে। তার পূর্বে ও সমসাময়িক যেসব শিক্ষক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তারা হলেন প্রয়াত এডভোকেট ভবানীচরণ চ্যাটার্জী, এডভোকেট ওয়ালিউর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব শামসুজ্জোহা, আনিসুর রহমান বিএসসি, এডভোকেট ইকবাল, হায়দার আলী, সেরাজুল হক, শেখ ফরজন আলী, মজিদুল হক, রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, তাজিমউদ্দিন বিএসসি, শামসুজ্জোহা ও জালালউদ্দিন দুলু। এখন যারা জীবিত আছেন তাদের মধ্যে হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সাইফুল্লাহ কলম, আশুতোষ নাথ, সুকুমার নাথ ও মৌলভী স্যারের কথা খুব মনে পড়ে। প্রয়াত মজিদুল স্যারের বিখ্যাত ডায়ালগ- ‘ডোন্ট টক’, হাফিজউদ্দিন স্যারের- ‘নো দাইসেল্ফ’ ও আশুতোষ স্যারের পড়া না পারলে সেই বিখ্যাত ডায়ালগ- ‘এ তো দেখছি জঙ্গল থেকে এসেছে, জঙ্গলিয়ারে’ আজো ভুলিনি। আশুতোষ স্যার একজন সব্যসাচী শিক্ষক ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্র্রামার তিন বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্যার যখন ছুটি গল্পটি পড়াচ্ছিলেন তখনকার একটি দৃশ্য আজো মনে পড়ে। গল্পটি পড়ানোর সময় স্যার কখনো ফটিক হচ্ছেন তো কখনো ফটিকের মামা হচ্ছেন। প্রতিটি চরিত্রের সংলাপের সঙ্গে স্যারের কণ্ঠস্বরের ওঠানামা খুব অবাক করত আমাদের। ‘মামা আমার ছুটি হয়েছে মামা, আমি বাড়ি যাচ্ছি’- ছুটি গল্পের এই শেষ লাইনটি পড়ানোর সময় স্যারের মায়া জড়ানো ছলছল চোখ দুটো আজো চোখে ভাসে। সেদিন ফটিকের শোকে পুরো ক্লাস যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখানেই তো একজন শিক্ষকের শ্রেষ্ঠত্ব, অসীম সার্থকতা। এমন করেই ইংরেজি পড়াতেন হাফিজ উদ্দিন হাবু স্যার। তিনি ইংরেজিতে খুব দক্ষ ও ভীষণরকম শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক ছিলেন। ক্লাসে পড়ানোর সময় মাঝে-মাঝে স্যারের বুয়েটপড়–য়া দুই ছেলে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মেয়ের সাফল্যের গল্প বলতেন। আমরা তন্ময় হয়ে স্যারের সেসব গল্প শুনতাম আর অনুপ্রাণিত হতাম। কলম স্যার জীববিজ্ঞান এমনভাবে পড়াতেন যে, বাসায় গিয়ে খুব বেশি পড়ার প্রয়োজন হতো না। স্যার সবসময় পরিপাটি আর ভীষণ স্মার্টলি চলাফেরা করতেন। তার প্রখর ব্যক্তিত্ববোধ আমাদের মুগ্ধ করত। তাজিমউদ্দিন স্যার পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন খুব সহজভাবে। খুব মনখোলা ও উদারচিত্তের মানুষ ছিলেন তিনি। সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতে সুকুমার স্যার ও জালাল স্যারের ছিল অসামান্য দক্ষতা। তাদের সহজসাধ্য পড়ানোর স্টাইলের কারণেই গণিতের ভীতি চিরতরে দূর হয়েছিল আমার মতো অনেকের। ভীষণরকম ভক্ত ছিলাম জালাল স্যারের। তার শিশুসুলভ হাসিটা ভুলতে পারিনি আজো। মৌলভী স্যার (খলিল স্যার) ও ইব্রাহীম স্যার এখনো পড়িয়ে যাচ্ছেন। মৌলভী স্যারের পরিষ্কার ও শুদ্ধ বাচনভঙ্গি এখনো কানে বাজে। ইব্রাহীম স্যারও ভালো শিক্ষক ছিলেন। পূর্বসূরিদের মতো বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এই স্কুলের সম্মান রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বর্তমান প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমান স্যারের কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রমের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করে স্কুলটিকে আরো সামনের কাতারে নিয়ে এসেছে। শিক্ষার পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্কাউটিং, বিভিন্ন সৃজনশীল ও সমাজসেবামূলক কাজে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখে সবসময় সরব রেখেছে স্কুলের ধারাবাহিক সুনাম-সম্মান ও ঐতিহ্যকে। এই ধারাকে সামনে রেখে আরো বেগবান করতে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আরো বেশি যতœবান ও স্বপ্নবান হওয়ার সফল প্রয়াস চালাতে হবে, তবেই তিল-তিল করে গড়ে ওঠা তিলোত্তমা এই বিদ্যাপীঠ পাড়ি দিতে পারবে আরো অনাগত অযুতকাল। যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য শতবর্ষের মাইলফলক অতিক্রম এক শ্লাঘণীয় অর্জন। আর এই অর্জন কেবল প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার সেই কৃতিত্বের দ্যুতি প্রাণিত করে দেশ ও সমাজের সব কল্যাণযাত্রীকেই। এ বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি আমাদেরও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ধ্বজাতলে একনিষ্ঠ আলোর পথযাত্রী হতে। এই প্রিয় বিদ্যাপীঠ শতবর্ষ আগে আলোকের ঝর্ণাধারায় যে মঙ্গলদীপের শিখা জ¦ালিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সেই শিখার দ্যুতি উজ্জ্বল থেকে আরো উজ্জ্বলতর হোক। জয়তু লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। এ এস এম হাফিজুর রহমান সাবেক শিক্ষার্থী, লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App