×

মুক্তচিন্তা

বিভেদের দেয়াল চাই না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২২, ০২:০০ এএম

নড়াইলে প্রায় এক মাসের ব্যবধানে দুটি ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা দুটি মর্মান্তিক এবং পীড়াদায়ক। সূত্রপাত কিংবা ঘটনার ধরন ভিন্ন হলেও তা আমাদের সমাজের জন্য অশনি সংকেত। প্রথম ঘটনায় একজন অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল। তাতে শুধু শিক্ষকের যে শুধু সম্মানহানি হয়েছে তা নয়। সমাজের জ্ঞানসত্তা অস্তিত্বকে সংকটকে ফেলেছে। যার ফল জাতির বিবেক প্রতিনিয়ত দংশিত হচ্ছে। তবে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ায় অনেকেই প্রতিবাদে সরব হয়েছে। সভ্য সমাজ ভেবেছিল কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। রেহাই তো পেলই না উপরন্তু কিছুদিনের ব্যবধানে আরো একটি হামলার ঘটনা ঘটে। সেটা শিক্ষকের ওপর নয়, সম্প্রদায়কে টার্গেট করে। ন্যক্কারজনক হামলা ঘটে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়ায় সাহাপাড়ার লোকজনের ওপর। সেখানকার বাড়িঘর, দোকানপাট ও মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। উপাসনালয় পুড়িয়ে দিয়ে ভুক্তভোগীদের অস্তিত্বের সংকটকে জানান দেয়। নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসেবে থেকেছে সাহাপাড়ার লোকজন। প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক ছুটে পালিয়েছে। ঘর-বাড়ি লুট করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিশ্বাসের জায়গাটুকু। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কিছুটা চিড় ধরেছে। নিজের বাড়িটাই অনিরাপদ হয়ে উঠলে নিরাপত্তার স্থান কোথায় থাকবে। তাই সাহাপাড়ার লোকজনের ভেতরে যে ক্ষত হয়েছে তা সহজেই সেরে ওঠার নয়। হামলার পরের দিন সেখানকার সংসদ সদস্য এবং তারকা ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা হামলার স্থান পরিদর্শন করেন। তিনি বিচলিত হয়ে আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলছি, ছোটবেলা থেকে নড়াইলে বড় হয়েছি। এই নড়াইল আমি দেখিনি, এই নড়াইল আমি চিনি না।’ তার সত্য কথাগুলো কতজনের বিবেককে নাড়া দিয়েছে জানি না। তবে নড়াইল কিংবা দেশের অন্য যে কোনো জেলাই হোক, আমাদের বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্যকে ধারণ করেই বড় হয়েছি। কখনো জাতিতে জাতিতে বিভেদ দেখিনি। ছোটবেলা থেকে সমাজের মানুষকে কাছে থেকে দেখেছি। তাদের চিনতে শিখেছি, বুঝতে পেরেছি, সম্মান করতে শিখেছি। তাদের কাছ থেকে সৌহার্দ্য শিখেছি। কোনো কিছুর ব্যত্যয় হলে তারাই শুধরে নেয়ার চেষ্টা করত। একজনের অনুষ্ঠান হলে সমাজের আরেকজন ছাড়া অপূর্ণ থেকে যেত। এমনি ছিল সমাজের একজনের প্রতি আরেকজনের হৃদ্যতা। ফলে সম্প্রদায়গত কোনো সমস্যা অনুভব করিনি বা দেখিনি। এই যে সহমর্মিতা কিংবা পারস্পরিক শ্রদ্ধা তা ছিল তখনকার সমাজের ইতিবাচক দিক। যার ফলে একজন আরেকজনের দুঃসময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। সমাজ এখন অনেক পাল্টে গিয়েছে। সদা নিজেদের নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসি। তাই হয়তো অন্যের ভাবাবেগে আঘাত আসলে আমরা এখন বিচলিত হই না কিংবা পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি না। নিজের ভালো থাকাই পরম চাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য মুছে দিয়ে যখন পাশের বাড়ির চেনা লোকটি এসে আঘাতে শামিল হয় তখন সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতেই হয়। যখন সামাজিক মেলবন্ধনের ওপর আঘাত আসে তখন বুঝতে হবে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা হারিয়ে গেছে, সমাজ সংকটে পড়েছে। সে সমাজকে টিকিয়ে রাখা দায়! তাই সমাজকে নিয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে স্থানীয় দীঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ বোরহান উদ্দীন, ইউপি সদস্য জান্নাত মৃধা, আওয়ামী লীগ নেতা বনিরুল ইসলামসহ কয়েকজন হামলাকারীদের ঠেকাতে চেষ্টা করেন। হামলা ঠেকাতে গিয়ে আহত হন ইউপি সদস্য জান্নাত মৃধা, আওয়ামী লীগ নেতা বনিরুল ইসলাম। তাদের প্রতিরোধের কারণে হয়তো বড় ধরনের হামলা থেকে সেদিন নড়াইলের সাহাপাড়া বেঁচে গিয়েছে। হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করায় তাদের সাধুবাদ জানাই। দেশের অন্য স্থানগুলোতে হামলা ঠেকাতে যদি তাদের মতো কেউ এগিয়ে আসত তাহলে হয়তো রামু, নাসিরনগর, সাঁথিয়া, পীরগঞ্জ, শাল্লা কিংবা নোয়াখালী বড় ধরনের সহিংসতা থেকে রেহাই পেত। তবে নড়াইলসহ সারাদেশে এমন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তা আমরা মনে-প্রাণে চাই। আমরা চাই সম্প্রীতির মেলবন্ধন অটুট থাকুক। একে অপরের পাশে দাঁড়াক। তাই সুজিত সরকারের ভাষায় বলতেই পারি- ‘দেয়াল তুললেই ঘর, ভেঙে ফেললেই পৃথিবী।’ সে দেয়াল যেন বিভেদ সৃষ্টি না করে। আমরা আবারো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহে দেশকে দেখতে চাই। জার্মান মানবাধিকার কর্মী মার্টিন নিয়েমোলার দীর্ঘ কারাবাসের পর একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার একটি কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাই যা বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কবিতার লাইনগুলো হলো: ‘যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি, কারণ আমি কমিউনিস্ট নই। তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম, কারণ আমি শ্রমিক নই। তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে, আমি তখনো চুপ করে ছিলাম, কারণ আমি ইহুদি নই। আবারো আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি, কারণ আমি ক্যাথলিক নই। শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে, আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।’ অন্জন কুমার রায় লেখক, নড়াইল। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App