×

মুক্তচিন্তা

কেহ নাহি জানে, কার আহ্বানে…

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২২, ১২:২৯ এএম

রাজনীতির মাঠে সুবাতাস বইয়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ কি কারো নজরে পড়ছে? আমাদের দেশের রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থানে রাজনীতির আকাশে যে কালো মেঘ জমে আছে, তা কেটে রোদের আলো ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা কি কেউ দেখছেন? আমাদের দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাসই এখন পর্যন্ত ঠিকঠাকমতো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। বৃষ্টির সম্ভাবনা কম বললে মানুষ উল্টো বুঝে ছাতা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। রাজনীতির পূর্বাভাস দেয়া তো আরো জটিল। রাজনীতিবিদরা যা বলেন তা করেন না। আবার যা করেন তা প্রকাশ্যে বলেন না। এই প্রকাশ্যে এক আর গোপনে আরেক খেলা রাজনীতিকে মানুষের কাছে খেলো করেছে, রাজনীতিবিদরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিরোধী জোটের আলোচনার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে কোরবান আলীর এরশাদের মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড যেমন আছে, তেমনি শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না যাব না বলে ২০১৮ সালে পরিস্থিতি লেজেগোবরে করে বিএনপি জোটের নির্বাচনে যাওয়ার রেকর্ডও আছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের কথায় বিশ্বাস করে নির্বাচনে যাওয়া ভুল হয়েছিল। সরকারের কী ‘কথা’য় বিএনপি বিশ্বাস করেছিল, সেটা অবশ্য তারা খোলাসা করে বলেন না। সরকার কী বলেছিল, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে, নাকি সম্মানজনক আসন দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল? যদি আসন ভাগাভাগির সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি গত নির্বাচনে গিয়ে থাকে তাহলে তো বলতেই হয় যে, বিষয়টি ঠিক হয়নি। গোপনে কী সমঝোতা হয়, তা তো সবাই জানে না। গোপন সমঝোতা গোপনে ভাঙা রাজনীতির কোনো বড় অনৈতিক ঘটনা নয়। সম্ভবত এজন্যই সাজানো ভোটব্যবস্থায় বিজয়ী হওয়ার পরও মানুষ এ নিয়ে মুখ খোলেনি। বিএনপি মানুষের ওপর আস্থা রেখে এটা বলেনি যে, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে ভোটের বাক্সে তাদের প্রতিবাদ জানানো। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে কৌশল হিসেবে, কৌশলের খেলায় সরকার তাদের হারিয়ে দিয়েছে। মানুষ মনে করেছে, এগুলো ‘তাদের তাদের’ ব্যাপার, এতে জনগণের কিছু করার নেই! আগামী সাধারণ নির্বাচনের এখনো এক বছরেরও বেশি সময় বাকি। এই সময়টা দেখতে দেখতে চলে যাবে এটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক যে, দর কষাকষি করার জন্য এই সময়টাই উপযুক্ত। একদিক দিয়ে দেখলে দুই দলের কোনো দলই বিশেষ কোনো সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দলটির ভেতরে বাহুল্য মেদ জমেছে। কেউ কেউ অতিমাত্রায় ঘি-মাখন খেয়ে ফেলেছেন। অতিরিক্ত মেদ জমা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই আওয়ামী লীগের খবর পাওয়া যায়। তবে খবরগুলো ভালো নয়, খারাপ। দলের মধ্যে এখন গড়ে উঠেছে একাধিক দল বা গ্রুপ। এই গ্রুপিংয়ের কারণে গুঁতোগুঁতি নির্বাচনের সময় বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেউ কেউ তাই বলছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য বড় হুমকি বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই আওয়ামী লীগের জন্য বড় হুমকি। এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার কোনো সচেতন প্রচেষ্টা এখনো দৃশ্যমান নয়। আবার বিএনপিও এখন খুব সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে যারা ভাবছেন, তারা আসলে কল্পনার জগতে আছেন। বিএনপির সমস্যা বহুবিধ। দলটি বহু বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। অথচ বিএনপি তৈরি হয়েছে ক্ষমতায় থেকে। ক্ষমতাই এই দলটিকে পুষ্টি জোগায়। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে সব অর্থেই বিএনপি এখন বড় রকমের পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। দলের ব্যবসায়ী নেতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খুব ভালো চলার কথা নয়। অনেকেই একাধিক মামলার কারণে আদালতপাড়ায় দৌড়ে কূল পাচ্ছেন না। আবার দলের মধ্যে আছে দ্বৈত নেতৃত্বের সমস্যা। প্রধান দুই নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আবার স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার বঞ্চিত, দুজনই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, একজন দেশে থাকলেও রাজনীতিতে নেই, আরেকজন লন্ডনে ‘পলাতক’ থেকে ভার্চুয়াল সংযোগে কানকথা বলে দল চালান। এভাবে একটি বড় দল চলতে পারে না, যে দলটি ক্ষমতাসীন সরকারকে পরাভূত করে নিজেরা ক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের সংগঠন শক্তি মজবুত না হলে কীভাবে আন্দোলন হয়? আসলে সেজন্যই বিএনপি নেতারা আন্দোলনের কথা বলেই চলেছেন কিন্তু আন্দোলন হচ্ছে না। দিন, তারিখ বা সময় দিয়ে আন্দোলন হয় না, এই উপলব্ধি যতদিন বিএনপি নেতাদের না হবে ততদিন তাদের হুমকি দিয়েই চলতে হবে। বিএনপির রাজনীতি আটকে আছে নেতাদের কথার মধ্যে। মূলত গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যাচ্ছে বিএনপি নামক দলটি আছে। দেশের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত বলে যতই বলা হোক না কেন, কেউ এটা বলতে পারবেন না যে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা রিজভী সাহেব কিংবা অন্য কোনো নেতার বক্তব্য প্রচারে গণমাধ্যম কার্পণ্য করেছে। বিরতিহীনভাবে এই প্রচার চলছে যে, বিএনপি নির্বাচনের আগে সরকারের পতন চায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না। আবার সরকার ও আওয়ামী লীগও জোর দিয়েই বলছে যে নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের এই অনড় অবস্থানে যদি সত্যি সত্যি নির্বাচনে না যায়, তাহলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে? এই ধারণাটা এখনো আমাদের দেশে চালু আছে যে সব দল, বিশেষ করে বিএনপির মতো একটি বড় দল নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। নিজ নিজ কৌশল কী হবে, তা অনেকটা অস্পষ্ট রেখেছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। তবে পর পর তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকলেও দেশ-বিদেশে রাজনৈতিক চাপে থাকা আওয়ামী লীগের ভাবনা- কী করে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা যায়। অন্যদিকে দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির চাওয়া সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। দল দুটির মূল বিরোধ আগামী নির্বাচনের সময় কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে, নাকি হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ আলাপ নেই বহু বছর। তাহলে এ বিরোধ মিটবে কী করে, তার কোনো স্পষ্ট রূপরেখা এখনো নেই। অবশ্য ঘরে-বাইরে তাদের পরোক্ষ রাজনৈতিক বাক্যবিনিময় থেমে নেই। দল দুটির চাওয়া এক সুতোয় গাঁথতে নেতাদের পরোক্ষ আলাপকে রাজনৈতিক সমঝোতায় পরিণত করা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সামনাসামনি কথা বলার ইচ্ছার দিকটি প্রকাশিত হয়েছে খোদ দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছ থেকে। সেই সঙ্গে আছে প্রয়োজনে বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কোনো বাধা না দেয়ার ইঙ্গিত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতেও ‘বাধা দেয়া হবে না’ বলে ২৩ জুলাই আওয়ামী লীগের এক যৌথ সভায় মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলামোটরে যে বাধা দেয়া হয়, সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। আসুক না হেঁটে হেঁটে যত দূর আসতে পারে। কোনো আপত্তি নেই। আমি বসাব, চা খাওয়াব। কথা বলতে চাইলে শুনব।’ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো বাধা নেই বললেও একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, বোমাবাজি ও ভাঙচুর করলে ‘বাধা দেব এবং উপযুক্ত জবাব পাবে। এটাই বাস্তবতা।’ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যকে আগামী নির্বাচনের জন্য দলের প্রস্তুতির একটি অংশ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, চায়ের দাওয়াত দেয়ার কথা বলে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ শুরুর পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছেন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এলে চা খাওয়াব। তার আগে বলে দেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিস্টেম এনে দিচ্ছি। তাহলে চা খাওয়াতে অসুবিধা কী? সমস্যার সমাধান তো হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার।’ দেশে একটানা তিন মেয়াদে একটি সরকার ক্ষমতায় থাকার পর নির্বাচনের সময় যারা প্রশাসনে থাকবেন, তাদের মধ্যে এক ধরনের আনুগত্য থেকে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তখন কী হবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে এবং সব দল অংশ না নিলে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ থেকে যাবে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল মনে করছেন, নির্বাচনের সময় সরকারে যে-ই থাকুক, ভোটারদের ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিতে সরকারের সহায়তা লাগবেই লাগবে। সরকারের এটা সাংবিধানিক দায়িত্বও উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘ভোটাররা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয়, গণতান্ত্রিক চেতনাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয়, যারা ভোটার, তাদের ভোটকেন্দ্রে আসতে হবে। আর যদি তারা ভোটকেন্দ্রে না আসেন, তাহলে বোঝা যাবে গণতন্ত্রের অসুস্থতা রয়েছে; গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হচ্ছে।’ নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। সে আলোচনায় নানা রকম মত এলেও একটা কমন বিষয় আছে যে, সব দলকে নির্বাচনে আনতে হবে। আবার সরকারি দল ও তার মিত্ররা বলেছে, নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বা বর্জনের বিষয়টি একান্তই সেই রাজনৈতিক দলের নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এই বিতর্কে নির্বাচন কমিশনের জড়িত হওয়া উচিত নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন হবে কমিশনের অধীনে, সরকারের অধীনে নয়। সরকার শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। তবে যাই হোক না কেন, নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তার এখনই ইতি ঘটবে না। এটা চলতেই থাকবে। বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়েও কথা উঠছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশের বাইরের কাউকে নাক গলাতে দেয়া উচিত নয় বলে যেমন মত আছে, তেমনি তাদের দুয়ারে ধরনা দেয়ার ঘটনাও আছে। সিইসি অবশ্য বলেন, বিদেশি কূটনীতিকদের কেউ কমিশনকে কোনো পরামর্শ দেননি। তবে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। কোনো দলকে নির্বাচনে আসতে কমিশন বাধ্য করতে না পারলেও কমিশন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় বলেও তিনি জানিয়েছেন। তবে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, কখন কী হবে, কার আহ্বানে, কে কখন কীভাবে সাড়া দেবে, মানুষের মধ্যেও বা কোন সময় কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা নিয়ে আগাম মন্তব্য অন্তত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সম্ভব নয়।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App