×

জাতীয়

সার নিয়ে চাপে সরকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২২, ০৮:২৯ এএম

সার নিয়ে চাপে সরকার

সার। ফাইল ছবি

* গ্যাস সংকটে প্রধান দুটি সার কারখানা বন্ধ * কানাডা থেকে বেশি দামে কিনছে পটাশিয়াম **

গ্যাস সংকটের কারণে দেশের দুটি কারখানা বন্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সার নিয়ে চাপে পড়েছে সরকার। ঠিকঠাকভাবে তা মোকাবিলা করতে না পারলে আগামী জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বোরো মৌসুমে দেশে সারের সংকট তীব্র হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে সরকার বলছে, সংকট থাকলেও তা উতরে যাওয়া সম্ভব। এই খাতে ব্যয় বাড়লেও সরবরাহ সচল রাখা কঠিন হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশে সারের আমদানির বড় একটা অংশ আসে রাশিয়া থেকে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে সার আমদানি নানা সমস্যার মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার শুধু কানাডা থেকে বেশি দামে পটাশিয়াম কেনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যকে বেশি পরিমাণে ইউরিয়া সার দেয়ার কথা বললেও এখনো দেশগুলো ‘সবুজ সংকেত’ দেয়নি। সবমিলিয়ে আগামী জানুয়ারির পর সারের সংকট তৈরি হলে ফসল উৎপাদন থেকে ভোক্তাপর্যায় পর্যন্ত- সর্বস্তরে প্রভাব পড়বে। সারের সংকট দেখা দিলে এই খাতে দাম বাড়বে। এতে মানুষের ব্যয়ের বোঝা বাড়বে। সরকার সার ব্যবস্থানাকে অগ্রাধিকার দিলে অন্যান্য খাতে ব্যয় সংকোচন বা সমন্বয় করতে হবে। এভাবে উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তাপর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের চাপ পড়বে।

জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুল রাজ্জাক গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, সারের সংকট মোকাবিলায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তার মতে, এখন যে সার আছে তাতে চলতি রোপা আমন কিংবা রবি শস্যের ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটবে না। আগামী জানুয়ারি থেকে একটু চাপ পড়লেও পড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, তাও সংকট কাটানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু কিভাবে এই সংকট কাটানো যাবে তার বিস্তারিত তিনি এখনই বলতে চাননি।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) পরিচালক (বাণিজ্যিক) কাজী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, গ্যাসের সংকটের কারণে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ও জামালপুরে অবস্থিত যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে সার উৎপাদন বন্ধ আছে। এতে হয়ত দেশীয় উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্ধেকে নেমে আসবে। সৌদি আরব, দুবাই, কাতার ও মরক্কো থেকে আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করা হবে বলে জানান তিনি। তার মতে, এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ সরকার সার কিনে আনে; কিন্তু এখন যেহেতু সংকট চলছে সেহেতু ওই দেশগুলোকে বেশি পরিমাণে সার দেয়ার কথা বলেছে বাংলাদেশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বেশি পরিমাণে সার দিতে রাজি হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশা করছি তারা রাজি হবে এবং বাজারদর অনুযায়ী বাংলাদেশকে সার দেবে।

এদিকে, গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভায় সারের এই সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। সার সংক্রান্ত আলোচনার বিষয়টি টেনে এনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দেশে কয়েকটি সার কারখানা বন্ধ আছে। এতে সার সংকট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সার সংকট উত্তরণে করণীয় ঠিক করতে প্রধানমন্ত্রী কৃষি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়াও রাশিয়া, বেলারুশ ও কানাডা থেকে সার আনার চেষ্টা চলছে। আশা করা হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

তবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভায় সার নিয়ে আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই মোতাবেক আমরা কাজ করছি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। তবু আশা করছি আমাদের সংকট হবে না।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সার আমদানিতে ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়ছে সরকার। কৃষিপ্রধান দেশ হলেও সারের চাহিদার বিরাট অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে মেটানো হয়। তবে যে মূল্যেই আমদানি করা হোক না কেন, সেখানে ভর্তুকি যোগ করে সরকার কৃষকের কাছে নামমাত্র মূল্যে সার বিক্রি করে থাকে। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর সাড়ে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। তবে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ২৫ লাখ টন প্রয়োজন। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদন হয় প্রায় ১০ লাখ টন। চাহিদার বাকিটা সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং কাতার থেকে আমদানি করা হয়। এবার উৎপাদন কম হওয়ায় প্রায় ২২ লাখ টন সার আমদানি করতে হবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান বলছেন, ইউরিয়ার যে মজুত আছে সেটা আগামী মৌসুম পর্যন্ত চলবে। এছাড়া অন্যান্য সারের জন্য টেন্ডার করা হয়েছে। টিএসপি সার প্রয়োজন হয় সাড়ে সাত লাখ টন। কিন্তু দেশে উৎপাদন হয় এক লাখ টন। বাকিটা মরক্কো, তিউনিশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। ডিএপি সারের প্রয়োজন হয় সাড়ে ১৬ লাখ টন। তার মধ্যে সাড়ে ১৫ লাখ টন সার চীন ও জর্ডান থেকে আমদানি করা হয়। এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে আট লাখ টন, যার পুরোটাই বেলারুশ, রাশিয়া, কানাডা থেকে আমদানি করা হয়। সংকট মোকাবিলা সম্পর্কে তিনি বলেন, এখনো এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় রয়েছে, তাদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করব পরবর্তী কী করা যায়। কিন্তু সেই বৈঠকের তারিখ এখনো ঠিক হয়নি।

কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে কৃষি সরঞ্জাম ও উপকরণের ওপরে বরাবরই ভর্তুকি দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার। গত একযুগে সেই ভর্তুকির পরিমাণও অনেক বেড়েছে। সার বাবদ সরকারকে ভর্তুকি দিতে হত ৮ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ শুধু সার বাবদ সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবার আরো বেশি ভর্তুকি দিতে হবে বলে ধারণা করছে ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ভর্তুকি তুলে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু কৃষকদের স্বার্থে সরকার ভর্তুকি তুলে দেয়ার বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App