×

মুক্তচিন্তা

সংখ্যালঘুতে ফের খেলারামের খেলা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২২, ১২:৩৪ এএম

সংখ্যালঘুতে ফের খেলারামের খেলা

আজ এখানে, কাল সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও মন্দিরে হামলা। নানান ছুতায় কিলঘুষি, চড়থাপ্পড়। কানধরে ওঠবস। মার দিয়ে মারের খবর অস্বীকার করার মুচলেকা আদায়। নইলে পরে ডাবল মারের সতর্কতা। এ ধরনের সব খবরাখবর গণমাধ্যমে আসে না। মাত্রাগতভাবে ঘটনার ব্যাপকতা বেশি হয়ে গেলে গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ক’দিন মাতামাতি-মায়াকান্না। সাহায্য-সহায়তা নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন। মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের পাশে থাকার ওয়াদা, রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। এর ফাঁকেই অন্য কোনো ঘটনায় ইসু্যু তলিয়ে যাওয়া। এভাবে চলতে চলতে সম্প্রতি আবারো সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঢোলে বাড়ি। উত্তরবঙ্গের রংপুর, সাগরতীর কক্সবাজারের রামু বা পূর্বাঞ্চলে, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ নানা জায়গা হয়ে সাম্প্রদায়িক অঘটনের এই দৈত্য ক’দিন আগে নোঙর করেছে নড়াইলে। হামলার পর বরাবরের মতো একদিকে বিবৃতি, বক্তৃতা, দোষারোপ, সমবেদনা জানাতে নড়াইলে ছুটে যাওয়া। আরেকদিকে সংখ্যালঘুদের ভাঙা ঘর, ভাঙা দোকান মেরামতের দৃশ্য। কিন্তু নির্যাতনের শিকারদের মন-মনন কি মেরামত হচ্ছে বা হবে? তারা কি ভাবতে পারছেন দেশটা তাদেরও? নিশ্চিত হতে পারছেন, আর কোথাও ঘটবে না এমন ঘটনা? যদিও বরাবরের মতো সরকারের ঘোষণা : গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কাউকে ছাড়া হবে না, আর ঘটবে না এমন ঘটনা। বাস্তবে সরকারের এসব ঘোষণা বাস্তবায়নের নমুনা দুঃখজনক। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচারহীনতা ও ভয় না পাওয়ার সংস্কৃতি বড় বেগবান। ঘটিয়ে দিলেই হয়ে যায়। ইস্যু দাঁড়িয়ে যায়। এ রাজনীতিতে যুক্ত সবাই জিতে যায়। সবর্নাশ যা হওয়ার হয় কেবল আক্রান্তদের। এতে প্রশ্ন এসেই যায়, সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতিটা কি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? এই অতিরাজনীতি সাদা চোখেই স্পষ্ট। ‘বেশি খেলায় বেশি ফাউল’ বলে একটা মেঠোকথার প্রচলন দেশে অনেকদিনের। বেশি ফাউলে বেশি পেনাল্টি এবং বেশি পেনাল্টিতে বেশি গোলের বিষয়ও সবার জানা। বাংলাদেশ কি সে ধরনের কোনো শিকারে পড়তে যাচ্ছে? বা কেউ চাচ্ছে দেশটাকে সেই খাদে ফেলতে? মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে কোনো ধর্মকে অবমাননার অধিকার কারো নেই। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মন্দির, বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর ও নির্যাতন করার অধিকারও কারো নেই। এরপরও কখনো বিরতি দিয়ে কখনো হিড়িকের মতো একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলছে। ঘটনাগুলোকে মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার সুযোগ নেই। আলামত বলছে, এসব ঘটনা অবশ্যই পরিকল্পিত। ফেসবুকে ধর্মীয় উসকানির আড়ালে আরো বেশি পরিকল্পনা। সূত্র বা শক্তি অভিন্ন। দেশে একটা বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ তাদের আকাক্সক্ষা। চল্লিশের দশক থেকেই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিষ্করণ বা সাফাই শুরু। আফগানিস্তান-পাকিস্তানে এই পরিষ্করণ প্রায় শতভাগ সম্পূর্ণ হয়েছে। জনগণের আজতক জানা হয়নি সংখ্যালঘু পাড়ায় হামলার খেলারাম কারা? সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর হামলার জন্য ভারত-বাংলাদেশে সচরাচর ধর্মান্ধদের দায়ী করা হয়। ধর্মান্ধতা মানে নিছক নিজের ধর্মকে অন্ধভাবে ভালোবাসা নয়। একজন ধর্মান্ধ নিজের ধর্মের মহত্ত্বের বিষয়ে এতটাই অন্ধ যে, অন্য ধর্মকে সে তুচ্ছ মনে করে। অন্য ধর্মাবলম্বীরা তার কাছে নস্যি। অন্ধবিশ্বাসের কারণে ধর্মের অনুসারীরা কমবেশি শিশুও বটে। তাদের এই শিশুতোষ বোধ-বুদ্ধিকে শান দেয় কারা? এখন কি ব্রিটিশরা আছে? এক সময় বলা হতো ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ আরোপ করে ইংরেজরা হিন্দু-মুসলিমের ঘৃণাকে উসকে দিয়েছে। এখন কারা উসকায়? উপমহাদেশে ইংরেজ আগমনের আগেও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা-হামলা কমবেশি হয়েছে। গত হাজার বছরে তাদের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা আর অবজ্ঞা যেমন ছিল, তেমনি উভয়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানও বিরল ছিল না। দাঙ্গাগুলো কেবল ঘৃণা আর অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ হয়ে থাকলে সুফিবাদ, মাজার, গাজীর গান, সত্যপীরের পূজা হতো কীভাবে? চল্লিশের দশকে এই ঘৃণা মহাদাঙ্গায় রূপান্তরিত হওয়া কিংবা পাকিস্তান আমলজুড়ে পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা হওয়া কিংবা বাংলাদেশে ক’দিন পরপরই তুচ্ছ অজুহাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকে ইংরেজদের অপকর্ম বললে ভুল বলা হবে। একান্ত নিজের স্বার্থে এসব দাঙ্গার আয়োজন এবং অর্থায়নে এদেশীয় রাজনীতিকদের সম্পৃক্ততা কম নয়। ঘটনার পরম্পরায় এখন একবাক্যে গোটা জাতকেই দায়ী করার বাতিক রয়েছে। বাঙালি ধর্মান্ধ হয়ে গেছে, ধর্মান্ধদেরই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার জন্য দায়ী করার প্রবণতা রয়েছে। তা আড়ালের খেলারামদের জন্য আনন্দের। তা তাদের আড়ালে থেকে খুশিতে বগল বাজানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। ধর্মান্ধতার তলোয়ার দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হলেও তলোয়ারের হাতলটা তারা আচ্ছা মতো ধরে রাখতে পারছে। এর বিপরীতে মুখে দাবি করলেই কেউ অসাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। কাজে এর প্রমাণ দিতে হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর দানবীয় সহিংসতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশনের সুপারিশগুলো এখনো ফাইলবন্দি। তারও পর এ সরকারের আমলে রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, সাঁথিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলাকারীদের কি শাস্তি দেয়া হয়েছে? তা কি দেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপদ ভাবনা জাগায়? হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ কখনোই চরম অসাম্প্রদায়িক বা চরম সাম্প্রদায়িক ছিল না। সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িকার রসায়নে মেলানো বাঙালি বেশ সামাজিক। খাদ্যাভ্যাস, বিয়ে-শাদি, ছেলেমেয়েদের নাম রাখা ইত্যাদি ব্যাপারে সাম্প্রদায়িক পার্থক্য থাকলেও তারা সহাবস্থানে অভ্যস্ত। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ ধরনের সেøাগান রচনা করে তাদের সহাবস্থানে আনতে হয়নি। বুকে বুক মিলিয়ে না চললেও পরস্পরকে কনুই মারার চর্চা করেনি। কিন্তু সময়ে সময়ে তাদের বাধিয়ে দিয়ে সুফল হাতিয়ে নেয় খেলারামরা। সেই অতিখেলায় হুইসেল দেয়ার প্রবণতা গত কয়েক বছর বাড়ছে। এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হয়েছে সুফিবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। মানবতা-উদারতায় ইতিহাস হয়ে আছেন তারা। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের আগে এ দেশে ছিল সহজিয়া মতবাদ নামে একটি বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন ও সংস্কৃতির প্রভাব। লোকায়ত ওই মতবাদের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা মনে করা হয় শ্রীচৈতন্য, কবি চণ্ডীদাস, বাউল সাধকদের। গ্রামীণ হিন্দু-মুসলিম সব মানুষের কাছেই নমস্য ছিলেন তারা। মূল তফাৎ ছিল আচার-আচরণে। তা সমাজে সম্প্রীতিতে প্রভাব ফেলেনি। দাওয়াত-নেমন্তন্ন বিনিময় হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশে অনেকটা মিথের মতো। বাস্তবে বা নিকট অতীতে এখানে চমৎকার সম্প্রীতি ছিল না। আবার চরম অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণও কম। যার যার ধর্ম যার যার মতো পালন হয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিভাজন তেমন ঘটনার মধ্যে আসেনি। এটিকে চাঙ্গা করার খেলা খেলেছে ব্রিটিশরা। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ শাসকদের সরাসরি মদতে সৃষ্টি হলো দুটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা। তারা মানুষকে দুটি দলই খাইয়ে ছেড়েছে। খেতে খেতে মহাখাদ্য হয়ে গেছে ধর্মখেলা। জাতীয়তাবাদী শক্তির বিশ্বাসঘাতকতা, বাম শক্তির ব্যর্থতাসহ নানা ঘটনা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে কেবলই প্রাণ জুগিয়েছে। বিগত কয়েক বছরে তা আরো মাত্রা পেয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, হামলা-মামলা, তাদের জায়গা-জমি দখল যেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। রামুতে বৌদ্ধমন্দির জ্বালিয়ে দেয়া, পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে হামলা, নওগাঁয় চারজন সাঁওতাল কৃষককে হত্যা করা, দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির উচ্ছেদের চেষ্টা, চিরিরবন্দরে হিন্দু উপাসনালয়ে আক্রমণ, পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতকে হত্যা, নড়াইলের মতো নজির কেবল তৈরিই হচ্ছে। কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু প্রশ্নে সম্প্রীতি আর সম্পত্তি এক করে ফেলা হচ্ছে। শুনতেও তা কাছাকাছি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, হাজংসহ বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমিজমা দখলের অনাচারও চলছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে ঘটা সহিংসতার বেশিরভাগই ঘটেছে একপক্ষীয়ভাবে। কোনো কোনোটির নেপথ্য রহস্য লুকানো সম্পত্তিতে। তা হাত করতে ঘটানো হয় পরিকল্পিত কাণ্ডকীর্তি। সংখ্যালঘুদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, বসতবাড়িতে লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ, উপাসনালয় আক্রমণের প্রায় প্রতিটিই পরিকল্পিত। ঘটনাকে ছক মতো টেনে নেয়া হয় সম্প্রদায়গত দিকে। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর যারপরনাই অমানবিক-দানবীয় ভূমিকা ওপেন সিক্রেট। তা হালে আরেকটু ওপেন।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App