×

মুক্তচিন্তা

‘চাঁনমুখর মধুর হাসি’ বঙ্গবন্ধু টানেল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২২, ১২:৩৩ এএম

‘চাঁনমুখর মধুর হাসি দেবাইল্যা বানাইলোরে মোরে সাম্পানের মাঝি’ এ রকম হাজারো গান-কবিতা রচিত হয়েছে কর্ণফুলী ও এই নদীর বিখ্যাত সাম্পানকে ঘিরে। প্রায় দেড় দশক আগে চট্টগ্রামের একটি জনসভায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের অঙ্গীকার করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই ধারাবাহিকতায় নির্মাণকাজের শেষ প্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। ১৯৭১-এর ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধকালে নৌ কমান্ডোরা যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন তা রচিত হয়েছিল কর্ণফুলী নদীর বুকে। ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামের এই অভিযানে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করে দিয়ে বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’-এর বার্তা। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই কর্ণফুলীর বুক চিরে খুলছে দেশের আরেকটি স্বর্ণ দুয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ঙহব পরঃু ঃড়ি ঞড়হি’ হিসেবে গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে নদীর দুই পাড়ে দুটি শহর। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন এন্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এই কাজটি করছে, যার ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। স্বপ্ন যিনি দেখাতে জানেন বাস্তবায়নও তিনি করেন, যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আগামী ডিসেম্বরে এই টানেল চালু করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালে টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা সম্পন্ন করে চায়না কমিউনেকেশন এন্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। ২০১৫ সালের ৩০ জুন চীনের সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের জিটুজি যৌথ অর্থায়নে ১০ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (প্রায়) দিয়েছে বাংলাদেশ, বাকি টাকা চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ হিসেবে দিয়েছে। টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার, টানেলটিতে থাকছে দুটি টিউব, যেগুলোর মধ্যে যানবাহন চলাচল করবে। দুটি টিউবের নির্মাণ বা খনন কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের এই টানেলের টিউব দুটির গভীরতা ১৮-৩১ মিটার, ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতা। টানেলের ভেতরে ৪টি লেন থাকবে। চট্টগ্রাম শহর প্রান্তের পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির পাশ থেকে শুরু হওয়া এই টানেল কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তে ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানা এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। নদীর মধ্যভাগে টানেলের অবস্থান ১৫০ ফুট গভীরে। টানেলের পাশাপাশি ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৮০ কিলোমিটার গতিতে যান চলাচল করবে এই টানেল দিয়ে, যার ফলে চট্টগ্রাম শহরে ট্রাফিক চাপ অনেকাংশে কমে যাবে, তবে আউটার রিং রোডগুলোর কাজ খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। টানেলের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য ইতোমধ্যেই দুই প্রান্তে দুটি থানার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। টানেলের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জাতীয় মহাসড়কের উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের প্রসার, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, চট্টগ্রাম শহরে যুগোপযোগী সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নদীর পূর্ব পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ডাউন টাউনকে যুক্ত করে উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত হবে। তাছাড়া মিরসরাই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল, আনোয়ারা শিল্পাঞ্চল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, বন্দর বে টার্মিনালকে সংযুক্ত করে এবং চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে গড়ে ওঠা এই টানেল অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এবং বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের কর্মচাঞ্চল্য আরো বেগবান হবে। অর্থনীতিবিদদের মতে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ফাইন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক ইন্টারনেল রেইট অব রিটার্নের (আইআরআর) পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬.১৯ ও ১২.৪৯ শতাংশ। তাছাড়া ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক বেনিফিট কস্ট রেশিওর পরিমাণ হবে যথাক্রমে ১.০৫ ও ১.৫। পদ্মা সেতুর পর দেশের উন্নয়নের মুকুটে যুক্ত হতে যাচ্ছে আরো একটি পালক যার রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। টানেল বা সুড়ঙ্গ পথ এখন বাংলাদেশের মানুষের জন্য কল্পনায় বা সিনেমায় দেখা কিন্তু ছুঁতে না পারা বস্তু নয়, এটি এখন জনগণের ‘চাঁনমুখর মধুর হাসি’।

আ ফ ম মোদাচ্ছের আলী : শিশুসাহিত্যিক ও গবেষক, চট্টগ্রাম। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App