×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষকের মর্যাদা ও নিরাপত্তা জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২২, ০১:৩৬ এএম

শিক্ষাদান নিছক অর্থোপার্জনমূলক কোনো বৃত্তি নয় বরং তা একটি মহান ও বিশেষ ধরনের পেশা। পেশা আর বৃত্তির ব্যবধান বিস্তর- এটা সবার জানা কথাই। শিক্ষকতা পেশাকে পেশার মানদণ্ডে নিতে না পারলে শিক্ষা বিতরণ করা কিংবা সত্যিকার অর্থে একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠা যারপরনাই মুশকিল। শিক্ষক কোনো কর্মকর্তা নন বরং বিদ্যাদাতা। তাই তার কোনো নির্বাহী ক্ষমতার মনোবাসনা থাকা সমীচীন নয়। আদতে শিক্ষাগুরুর সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা অন্য পেশাজীবীদের থেকে ভিন্নতর। এ কথা বলা বাহুল্য যে, এখনকার সিংহভাগ অভিভাবক ফলাফলমুখী মনোভাবের অধিকারী। যাদের আরোপিত প্রত্যাশার চাপে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিদারুণভাবে পিষ্ট হয়। অনেক সময় শিশুদের যথাযথ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, অন্তঃপারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার পরিপক্বতা ও শৈশব উপভোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বঞ্চিত শৈশবের জোগান দিয়ে প্রকৃত শিখনের খেই হারিয়ে মানবিক গুণাবলি বিবর্জিত কোনো সামাজিক একক দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের অমূলক ভাবনাও থাকে অনেকের মধ্যে। একজন মানব শিশুর প্রথম পাঠ হলো তার পরিবার। পরিবার থেকে অর্জিত শিক্ষা-দীক্ষা, বোধ-বোধি, রীতি-নীতি, নৈতিকতা-আদর্শ ও সামগ্রিক জীবনচারণের প্রভাব অনিবার্যভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রতিফলিত হয়। আর এ প্রভাব হয়ে ওঠে বিস্তর ও সুদূরপ্রসারী। ভালো নম্বর পাওয়া মানেই ভালো বিদ্যার্জন নয়। উচ্চ মাধ্যমিকের চৌহদ্দি পেরিয়ে অনেকেই উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষত দোরগোড়ায় যেতে পারে না। এমন মৌলিকত্ব বিবর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ওজনদার সিজিপিএ-নির্ভর সনদ প্রসব করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষায় কোনো একটি ‘ইউনিটে’ তাই ফেল করে শতকে প্রায় ৯০ জন! ভাবা যায় এমনতর পরিস্থিতির কথা! বর্তমানে তথাকথিত মোটাদাগের ফলাফলকে শিক্ষার্জনের অন্যতম প্রধান সূচক হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী কী শিখছে, কীভাবে শিখছে, কেন শিখছে- সে বিষয়ে কারো কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই। শুধু স্বাস্থ্যকর জিপিএ হলেই কেল্লা ফতেহ। শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রপট বদলের জন্য সর্বপ্রথম এ ভ্রমময় মানসিকতার পরিহার অনিবার্য। শিক্ষকের মর্যাদা আগেকার সময়ে কোথায় ছিল আর এখন কোথায়- বিষয়টি আর সরলরৈখিক ভাবনায় সংকুলান হয় না। সমাজের প্রতিষ্ঠিত আচরণ কাঠামোতে আজ কতটা বদল! অসহিষ্ণু, অনভিপ্রেত সামাজিক মনোভাবের প্রকটতা আর ক্রমক্ষয়িষ্ণু সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের বেড়াজালে কাক্সিক্ষত আদর্শিক সমাজকাঠামো আজ পুরোপুরি নাজেহাল। বিত্তের আস্ফালন আর ক্ষমতার অশুভ দৌরাত্ম্য এখন সমাজের অনেক কিছুকেই প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটি তিক্ত সত্য যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে শিক্ষার পণ্যায়ন ঘটেছে জ্যামিতিক হারে। এখন শিক্ষাকে ‘প্যাকেজ ডিল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ শিক্ষার্জন ও এর বিতরণ একটি ভিন্নতর মানসিক প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির, মন-মগজ-হৃদয়ের ত্রিবিধ সম্মিলনে সম্পন্ন হয় পাঠগ্রহণ ও শিক্ষা বিতরণের মহৎ কর্ম। শিক্ষকদের নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা সমাজ ও রাষ্ট্রের যৌথ দায়িত্ব। জীবনের নিরাপত্তা আর সম্মানের ঘাটতি নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে জাতিকে ভালো কিছু দেয়া যায় না। যারা জাতি গড়ার নেপথ্য নায়ক, তাদের মর্যাদা আর নিরাপত্তার প্রশ্নে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে আপসহীন থাকতে হবে। বিত্তের জোরে বিদ্যা কেনার মানসিকতাও পরিহার করতে হবে। কোনো জাতির মেধাবী যুবাদের যদি শিক্ষকতা পেশা আকর্ষণ না করে, তবে সে জাতির কপালে সমূহ দুর্ভোগ আছে। সেজন্য মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত করা এবং দক্ষ-সৃষ্টিশীল শিক্ষকসমাজ তৈরির জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের তরফ থেকে শিক্ষক তৈরির বিশেষ স্কিম থাকা উচিত। পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষকের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার বিধান ও মর্যাদার নিশ্চায়ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়। অন্যথায় মানহীন অদক্ষ শিখন কারিগরের দ্বারা সৃষ্টকর্মে উৎকৃষ্ট ফল প্রত্যাশা দস্তুর মতো অসম্ভব। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক তারা কি আলাদা কেউ? নাকি পরস্পর পরস্পরের প্রতিপক্ষত্রয়ী? এ কথা মনে রাখতে হবে যে, পরস্পরের সম্মিলিত প্রয়াসে শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শিক্ষায় এ ত্রিবিধ যোগ তাই অপরিহার্য এবং অনিবার্য। শিক্ষা মানেই বহুমুখী একীভূত প্রচেষ্টা। এটা বাজারের কোনো পণ্য নয় যে তা একতরফাভাবে কেবল পুঁজিপতির ব্যাগেই ভরা হবে। সুতরাং শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ হোক নিরন্তর আনন্দপূর্ণ। শিক্ষকতা পেশা হোক সম্মান, মর্যাদা আর নিরাপত্তার প্রতীক। শিক্ষাগুরুর শির হোক সমুন্নত, হৃদয় হোক উন্মুক্ত, বক্ষ হোক স্ফীত। তবেই আশা করা যায় যে, দেশ ও জাতি এতে সর্বাংশে উপকৃত হবে। ওয়ারেছ আলী খান শিক্ষক ও সমাজকর্মী। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App