×

মুক্তচিন্তা

প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নির্বাচন ভাবী ভারতের ক্ষমতার দিকনির্দেশক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২২, ০১:৩৬ এএম

বিজেপি পরিচালিত জোট এনডিএর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু ভোটে জিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন। ওড়িশার প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপারবিড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের দুঙ্গুরিশাহী গ্রামে দ্রৌপদী মুর্মুর আদি বাড়ি। সেখানে এত দিন কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। এক সময়ে এখানকার দুঙ্গুরিশাহী গ্রামেই থাকতেন দ্রৌপদী। কিছুদিন আগে তিনি এখানকার বসবাস তুলে চলে গিয়েছিলেন ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রায়রাংপুর গ্রামে, যেখানে বিদ্যুৎ আছে। দ্রৌপদীর নাম ঘোষণার পরে তড়িঘড়ি তার আদি গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্রৌপদী মুর্মু ১৯৫৮ সালের ২০ জুন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বাইদাপোসি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের শিক্ষা শেষ করে ভুবনেশ্বরের রামাদেবী মহিলা কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতক হন। ওড়িশা সরকারের সেচ ও বিদ্যুৎ বিভাগে ক্লার্কের পদে চাকরিজীবন শুরু করেন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি রায়রাংপুরের শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন সেন্টারে শিক্ষিকার কাজও করেছেন। ১৯৯৭ সালে ওড়িশার রায়রাংপুর নগর পঞ্চায়েতের কাউন্সিলর হন। এরপরই শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। দ্রৌপদী বিজেপির তফসিলি উপজাতি মোর্চার সহসভাপতি ছিলেন। দক্ষতার সঙ্গে সংগঠন সামলেছিলেন বলে বিজেপির দাবি। তার রাজনৈতিক পথ ছিল মসৃণ। ২০০০ সালে রায়রাংরপুর কেন্দ্র থেকে বিধানসভা ভোটে জিতে নবীন পট্টনায়েক নেতৃত্বাধীন বিজেডি-বিজেপি সরকারের মন্ত্রী হন দ্রৌপদী। প্রথম দফায় শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি পরিবহন, পশুপালন ও মৎস্য দপ্তরও সামলান। ২০০৪ সালে ওই কেন্দ্র থেকে ফের বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরিবহন, পশুপালন এবং মৎস্য দপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল তার হাতে। তার বাবা বিরাঞ্চি নারায়ণ টুডু ছিলেন ঝাড়খণ্ডের নবম রাজ্যপাল। তিনিই ঝাড়খণ্ডের প্রথম রাজ্যপাল যিনি ৫ বছরের কার্যকালের মেয়াদ পূরণ করতে পেরেছিলেন। ২০০৭ সালে ওড়িশার সেরা বিধায়ক হিসেবে নীলকণ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু। ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হওয়ারও গৌরব রয়েছে দ্রৌপদীর মুকুটে। ২০১৫ সালের ১৮ মে ঝাড়খণ্ডের নবম রাজ্যপাল হিসেবে শপথ নেন তিনি। তিনিই ঝাড়খণ্ডের প্রথম রাজ্যপাল, যিনি পুরো মেয়াদ শেষ করেছিলেন। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার নাম ভেসে উঠেছিল বিজেপি শিবিরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিহারের রাজ্যপাল রামনাথ কোবিন্দের নামে ছাড়পত্র দেয় গেরুয়া শিবির। রাজনীতির পথ মসৃণ হলেও যন্ত্রণাদায়ক ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন। স্বামী ও দুই ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি। বর্তমানে রয়েছেন এক মেয়ে। বস্তুত অনেক অঙ্ক কষেই বিজেপি দ্রৌপদীকে প্রার্থী করেছিল এবং তার অভিঘাত এতটাই যে বিরোধী গোষ্ঠীর কাণ্ডারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবধি বলতে বাধ্য হয়েছেন যে আগে জানলে দ্রৌপদী মুর্মুকেই সমর্থন করা যেত। ভারতে রাষ্ট্রপতি পদ নিতান্তই আলঙ্কারিক যতক্ষণ না কোনো সাংবিধানিক সংকট হচ্ছে। কিন্তু তাহলে এই পদ ঘিরে এত উত্তেজনা কেন? এই পদের নির্বাচন ভবিষ্যতের শাসনব্যবস্থার জন্য সহায়ক হোক সেটা সব রাজনৈতিক দল চায়। সেই অঙ্ক যেমন অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তেমনই সুদূর ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেও। বিজেপি যে গোটা দেশে ক্ষমতা বিস্তারের স্বপ্ন দেখছে, তা হায়দরাবাদেই স্পষ্ট করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দাবি করেছেন, আগামী তিন-চার দশক ভারতে ‘বিজেপি রাজ’ চলবে। শুধু মুখে বলাই নয়, দলের রাজনৈতিক প্রস্তাবেও এই কথার উল্লেখ করা হয়েছে। সেই দীর্ঘমেয়াদি অঙ্কের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের অঙ্ক মেলানোর অন্যতম ‘অবলম্বন’ হতে চলেছেন দ্রৌপদী। সব রাজ্য মিলিয়ে দেশে মোট বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৪ হাজার ১২০। এর মধ্যে আদিবাসী সম্প্রদায় ভোটে ভাগ্য নির্ধারণ করে এমন তফসিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত ৫৫৬ আসন। আর এমন লোকসভা আসনের সংখ্যা ৪৭। আবার যদি উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে তাকানো যায়, তবে সেখানে আদিবাসী সম্প্রদায়ই মূল শক্তি। ভারতে মোট জনসংখ্যার ৮.৬ শতাংশ আদিবাসী হলেও মিজোরামে সেটা ৯৪.৪ শতাংশ। নাগাল্যান্ড, মেঘালয়ে ৮৬ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালে ভোট রয়েছে ছত্তিসগড়, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে। ওই চার রাজ্য মিলিয়ে আদিবাসীপ্রধান ১২৮ আসনের মধ্যে ৮৬টি রয়েছে কংগ্রেসের দখলে। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্নাটক মিলিয়ে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৯৭। যার মধ্যে মাত্র চারটি আছে বিজেপির দখলে। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, দ্রৌপদীকে রাষ্ট্রপতি করে আদিবাসী সমাজের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চায় বিজেপি। দ্রৌপদী মুর্মু আসলে প্রতীক, একাধারে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ এবং মহিলা। বিজেপি দ্রুত পাল্টে ফেলছে নিজেকে। আগে বিজেপি ছিল হিন্দিভাষী উচ্চ ও মধ্যবর্ণের এবং শহুরে মানুষের দল। আর এখন বিজেপি সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। ভারতের বিদায়ী রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ রাষ্ট্রপতি হওয়ায় দলিতদের কী উপকার হয়েছে? তেমন কিছুই হয়নি। আজো জাতীয় স্তরে বিজেপির সেভাবে কোনো আদিবাসী মুখ নেই। কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে কয়েকটি সত্য উঠে আসে। ‘সাঁওতাল’ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দ্রৌপদীর জাতিগত পরিচয় উল্লেখ না করলেও প্রধানমন্ত্রী মোদি তার টুইটে ‘প্রান্তিক’ শব্দটির উল্লেখ করেছেন। দলিত রামনাথ কোবিন্দের পর একজন আদিবাসীকে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর এই সিদ্ধান্তকে বলা যেতে পারে বিজেপির ‘মাস্টারস্ট্রোক’। যার মাধ্যমে বিজেপি বার্তা দিতে চেয়েছে, তারা দেশের প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে আছে। তারা প্রান্তিক মানুষদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে চায়। বিরোধী শিবিরে যেখানে প্রতিষ্ঠিত, পরিচিত এবং উচ্চবর্গীয় রাজনীতিকদের রাষ্ট্রপতি করার দিকে ঝুঁকেছে, সেখানে বিজেপি দেখাতে চেয়েছে, তারা প্রান্তিক মানুষের পাশে রয়েছে। এই প্রথম কোনো মূলবাসীকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য বেছে নিয়েছে বিজেপি। ঘটনাচক্রে প্রধানমন্ত্রী মোদিও ‘নিম্নবর্গীয়’ অংশের মানুষ। তার পরিবারও গুজরাটের ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের। যারা সরকারি হিসেবে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি)। মূলত তেল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হতেন ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের মানুষরা। সমাজ কী ভাবে সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু মোদি নিজেকে ‘নীচু জাত’ বলে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। নিজেকে ‘চা-ওয়ালা’ বলার পেছনেও মাটির সঙ্গে নিজের যোগ, গরিবের প্রতিনিধিত্ব করার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী জমানায় বিজেপিই রাষ্ট্রপতি করেছিল এপিজে আবদুল কালামকে। তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের হলেও। এবার আরো এক ধাপ এগিয়ে তা হয়েছে ‘প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি’। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে ভালো ফল হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। সেখানে দেখা গিয়েছিল, রাজ্যের সংরক্ষিত আসনগুলো জয়ের ক্ষেত্রে শাসক তৃণমূলের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিল বিজেপি। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নানা পরীক্ষার মুখে বিজেপি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তো আছেই, সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে পথ সহজ নয় মোদিদের। সেই পরীক্ষায় পাস করতে আদিবাসী অঙ্ক কষছে বিজেপি। পুরোটাই রাজনীতির পাশাখেলা। রাজনীতির সেই দ্যূতক্রীড়ার আসরেই দ্রৌপদীর আবির্ভাব। ভারতের রাজনীতিতে জাতপাতের অঙ্কের নিপুণ বিশারদ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। মুসলমান ভোট বাদ দিয়ে নিরঙ্কুশ জয়ের অঙ্ক পাকা। কিছুদিনের মধ্যে বেশ কিছু মুসলমান বিজেপির রাজনৈতিকও পাদপ্রদীপের আলোয় আসবেন বলে রাজনীতির উঠোনে গুজব। সেখানে মুসলমানদের মধ্যে সামান্য একটা অংশ বিজেপির দিকে চলে এলে বিরোধী দলগুলো ক্রমেই আঞ্চলিক দলে পরিণত হবে। কারণ তাদের মধ্যে ঐক্যের ছিটেফোঁটা নেই, যা দেখছি উপনির্বাচনের প্রাক্কালে। কাজেই বিরাট কোনো ঘটনা না ঘটলে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার আসছেই। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App