×

জাতীয়

ইউক্রেন-রাশিয়া খাদ্যশস্য রপ্তানি চুক্তি: আলো দেখছে বাংলাদেশও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২২, ০৮:৩৮ এএম

ইউক্রেন-রাশিয়া খাদ্যশস্য রপ্তানি চুক্তি: আলো দেখছে বাংলাদেশও

প্রতীকী ছবি

যুদ্ধ শুরুর দীর্ঘ পাঁচ মাস পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির পথ খুলে যাওয়ার ব্যাপারে আশার সঞ্চার হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে। ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো খুলে দিতে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিতে সই করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ৮টার দিকে ঐতিহাসিক এ চুক্তি সম্পন্ন হয়। এই চুক্তি সইয়ের বিষয়ে তুরস্ক ও জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা খাদ্য সংকটে বিপন্ন বিশ্বের জন্য সুখবর বয়ে এনেছে। চুক্তির ফলে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তাদের অবরোধ শিথিল করবে, যাতে ইউক্রেন থেকে জাহাজে করে খাদ্য রপ্তানি হতে পারে। তুরস্ক বলছে, এ চুক্তির ফলে শুধু ইউক্রেন নয়, কৃষ্ণসাগর দিয়ে রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিও সহজ হবে। চুক্তির খবরে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম একলাফে ৩ শতাংশ কমে গেছে। বাংলাদেশেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের গম আমদানির ৬০ শতাংশই আসে এ দুই দেশ থেকে। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে মাত্রায় অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে তাতে এ চুক্তি শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হবে এবং কতদিন তা টিকবে তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ চুক্তি সই হওয়ার পর দিনই গতকাল শনিবার ইউক্রেনের বৃহৎ বন্দর ওডেসায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।

খবরে বলা হচ্ছে, এ হামলায় বন্দরের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন যদি খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তি ভেস্তে যায় তাহলে এর জন্য দায়ী হবে রাশিয়া। অন্যদিকে, সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রধান খাদ্যশস্যের জন্য এ দুই দেশের ওপর নির্ভরশীল মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশে শিগগিরই খাদ্যসংকট মেটার সুযোগ নেই। তাই বিশ্বের প্রধান গম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া আগাম গম কিনে রাখার এবং এ বিষয়ে সরকারকে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার পরামর্শ তাদের।

বাংলাদেশে গম এখন সব শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাসের অংশ হয়ে গেছে। এই খাদ্যাভ্যাসের ফলে গত চার বছরে বাংলাদেশের গমের আমদানি ১৪ লাখ টন বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৫ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের পঞ্চম গম আমদানিকারক দেশে। তবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বের গমের বাজারে এর প্রভাব পড়ে, দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। বাংলাদেশের গমের অন্যতম উৎস রাশিয়া, ইউক্রেন ও সর্বশেষ ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে গমসহ খাদ্যশস্য রপ্তানি বিষয়ে তুরস্কের মধ্যস্ততায় ইস্তাম্বুলে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে এই চুক্তি সই হলো। বিশ্বজুড়ে যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে, এ চুক্তির ফলে তা কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, এ চুক্তির কারণে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে ভবিষ্যতের যে একটা হতাশা ছিল, তা থেকে কিছুটা আলোর দেখা মিলছে। যার কারণে চুক্তি ঘোষণার পরে আন্তর্জাতিক পণ্য বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। যদিও এটি ১২০ দিনের চুক্তি, তবে নবায়নযোগ্য। কিন্তু দুটি দেশের সঙ্গে এখনো যুদ্ধ চলছে। সে অবস্থায় খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে অবরোধ তুলে দেয়া সাময়িক হলেও এ ধরনের একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে এটাই অনেকটা আশার সঞ্চার করে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে যারা ভাবছিলেন, আগামীতে পণ্যমূল্য কমার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং এ কারণে অনেকেই গুদামজাত করে রেখেছেন। সেখানে এখন ভাটা পড়েছে। কাজেই কমোডিটি মাকের্টে একটি ইতিবাচক প্রভাব আশা করা যায়। যদিও আমরা ইউক্রেন বা রাশিয়া থেকে সরাসরি পণ্য আমাদনি করি না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দামের উপরে তো একটি প্রভাব পড়ছেই। এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি যদি আরো ঘোলা হয়ে যায়, তবে হয়তো চুক্তি নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু এ চুক্তির বাস্তবায়ন দুই দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই হয়েছে। এ চুক্তির ফলে যেখানে কোনো আশাই ছিল না, সব বাতি নেভানো ছিল- সেখানে দিগন্তের শেষ আলোটুকু দেখা যাচ্ছে। তাই এ সুযোগকে কাজে লাগাতে সরকারকে আরো কৌশলী হতে হবে। এখনই এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের আমদানিকরাকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।

চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশও এক্ষেত্রে লাভবান হবে উল্লেখ করে আমদানিকারক ও বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, আমরা আশা করব সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি খাতে গম আমদানির পথ সুগম করবে। তিনি বলেন, চুক্তিটা যদি কার্যকর হয় তবে ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তি বিশ্ববাজারে গমের দাম কমার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। সরবরাহ বাড়লে অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশও দাম কমাতে বাধ্য হবে। শুধু গম নয়, শর্ষে, তেলবীজ, ভুট্টার দামও কমতে পারে। বিশ্ববাজারে দাম কমলে আমরা কম দামে খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারব। তাৎক্ষণিক দাম কমার সুফল পাওয়া যাবে। আমরাও ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানির সুযোগ পাব। এ আমদানিকারক বলেন, আমরা সাধারণত তৃতীয় দেশের সরবরাহকারীর মাধ্যমে ইউক্রেন থেকে ৯০ শতাংশ পণ্য আমদানি করি। এসব সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে যোগাযোগসহ নানা অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। যেমন, ইউক্রেনের বন্দরে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ, সেখানে গুদাম থেকে বন্দরে পণ্য আনা পর্যন্ত অবকাঠামো ঠিক নেই। আবার বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কতটুকু আস্থায় নিচ্ছে- সেটিও একটি বিষয়। চুক্তি হওয়ায় এসব সমস্যা কেটে যাবে বলে আশা করছি। চুক্তিতে আপাতত ৩টি বন্দর খুলে দেয়ার কথা আছে। যুদ্ধ শুরুর সময় ইউক্রেনের বিভিন্ন বন্দরে ১০০টি পণ্যবোঝাই জাহাজ আটকা পড়েছিল। সেখানে নাবিকদের ফেরানোর বিষয়টি আছে। এসব চ্যালেঞ্জ কেটে গেলে সে দেশ থেকে আমদানি স্বাভাবিক হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পর্যন্ত মাত্র ২৭ হাজার ৮৮০ টন গম আমদানির ঋণপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই দশক আগেও আমাদের দেশে গমের রুটি ছিল গরিবের খাবার। চাহিদা বেশি ছিল না বলে আমদানিও হতো কম। আমদানি বলতে ছিল সরকারি খাতে। এখন উৎপাদন কমছে, আমদানি বেড়েছে। দেশের উৎপাদন দিয়ে বড় জোড় ১০ শতাংশ চাহিদা মিটছে। বেসরকারি খাতে চলে যাওয়ার পর দুই দশকের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ছয়গুণ। আমদানি আর সামান্য উৎপাদন মিলে এখন দেশে গমের চাহিদা বছরে ৭৫ লাখ টন। গম আমদানিতে এখন শতকোটি ডলার চলে যাচ্ছে বিদেশে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের টানাপড়েনে এবার তা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকায় বেশ কিছুদিন ধরেই এ চুক্তির জন্য তুরস্ক এবং জাতিসংঘ রাশিয়া ও ইউক্রেনের ভেতর মধ্যস্থতা করছিল। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার এ চুক্তি হয়েছে। তুরস্ক বলছে, এ চুক্তির ফলে শুধু ইউক্রেন নয়, কৃষ্ণসাগর দিয়ে রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিও সহজ হবে। পাঁচ মাস আগে যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়া ইউক্রেনের উপকূলের কাছে কৃষ্ণসাগরে নৌ অবরোধ দিলে ইউক্রেনের রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়ে। ইউক্রেনজুড়ে বিভিন্ন গুদামে প্রচুর খাদ্যশস্য মাসের পর মাস রপ্তানির জন্য পড়ে রয়েছে। কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী ওডেসা বন্দরে গুদামেই এখন দুই কোটি টনের মতো খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এগুলো এখন আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে সেখানে রপ্তানি করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা পল অ্যাডামস বলেছেন, কাগজে কলমে চুক্তি সবার জন্য অত্যন্ত সুখবর। পাঁচ মাস বাদে ইউক্রেন খাদ্য রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, খাদ্যকে রাশিয়া অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে এবং বহু দেশে দুর্ভিক্ষের কারণ হচ্ছে বলে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা খণ্ডনের একটি সুযোগ রাশিয়া পাবে। পল অ্যাডামস আরো বলেন, এমন অনেক ঝুঁকি রয়েছে যাতে যে কোনো সময় এ চুক্তি ভেস্তে যেতে পারে। কারণ, রাশিয়া যাতে সাগর পথে সৈন্য সমাবেশ না করতে পারে তার জন্য কৃষ্ণসাগরে উপকূলের কাছে বিশাল এলাকায় মাইন পেতে রেখেছে ইউক্রেন। জাহাজ বন্দরে ভেড়ার জন্য এখন তাদের সাগরে মাইন-মুক্ত ‘সেফ প্যাসেজ’ নিশ্চিত করতে হবে। ইউক্রেনের ভয়, সেটা করলে ভবিষ্যতে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ভবিষ্যতে তার সুযোগ নিতে পারে।

যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের যেসব ঝুঁকি : ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের ওপর যেসব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম গম। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটর এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের দামও এখন লাগামছাড়া। যদিও বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বেশিরভাগই আসে পাম অয়েল এবং সয়াবিন অয়েল থেকে। বিশ্বজুড়ে যেসব ভোজ্যতেল ব্যবহার হয় তার মধ্যে সানফ্লাওয়ার তেল প্রায় ১৩ শতাংশ। এর প্রায় ৭৫ শতাংশই আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে।

পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬ শতাংশ ভুট্টা সরবরাহ করে। পৃথিবীর আরো অনেক দেশে ভুট্টা উৎপাদিত হয়। যেহেতু ইউক্রেন থেকে ভুট্টা সরবরাহ আসতে পারছে না সেজন্য বিশ্বজুড়ে পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। এর ফলে বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে গেছে। আবার কৃষির অন্যতম উপাদান সারের সিংহভাগ রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং বেলারুশের ভূমিকা রয়েছে। রাশিয়ার ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় সেটি বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App