×

অর্থনীতি

আইএমএফ থেকে ঋণ নেবে সরকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২২, ০৮:৫১ এএম

আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বাড়ায় রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে রিজার্ভ, গত বছর যা বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা নেয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে সরকার। আইএমএফের কাছ থেকে এর আগে কখনই এত বড় অঙ্কের ঋণ নেয়নি বাংলাদেশ। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এ ঋণ নেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য দিলেও এখনো তা স্বীকার করেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশ ব্যাংকও শর্ত মেনে আইএমএফের ঋণ নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী বলে জানিয়েছে। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তবে আইএমএফের দেয়া শর্ত যেন দেশের স্বার্থের অনুকূলে থাকে, সেদিকে নজর রাখতে বলেছেন তারা। বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণ নেয়ার পক্ষে মত দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা শুরু ভালো দিক হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, ২ বিলিয়ন ডলার হোক আর সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার- আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার প্রয়োজন আছে। এটা মধ্য মেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীরা এক ধরনের আস্থা পাবেন।

জানা গেছে, আইএমএফের স্টাফ মিশন চলে যাওয়ার পর বাজেট সহায়তা চেয়ে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি পাঠাবে সরকার। এরপর ঋণের শর্ত নিয়ে বৈঠক করতে আরেকটি দল আসবে। ওই দলের নেতৃত্ব দেবেন আইএমএফের ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা অংশের নির্বাহী পরিচালক সুরজিৎ বালা। ওই সফরে আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত এবং অন্যান্য আলোচনা চূড়ান্ত হতে পারে। এরপর ঋণ অনুমোদনের জন্য ওয়াশিংটনে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদন পেলে দেশের ইতিহাসে আইএমএফ থেকে পঞ্চমবারের মতো ঋণ নেয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পেলে অবশ্যই আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো। কারণ রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সময়ও চলে এসেছে। তবে দেখতে হবে, শর্তগুলো গ্রহণযোগ্য কী না। তারা যদি বলে, সব ভর্তুকি বন্ধ করে দিতে হবে, কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া যাবে না- তবে সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না।

একই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থের অনুকূলে থাকে এমন শর্ত মানতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শর্তের বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। কারণ এ মুহূর্তে ভর্তুকি কমালে সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করবে। অতীতে আইএমএফ এ রকম অনেক শর্ত দিয়েছে, যা শতভাগ বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল না। অনেক শর্তের কারণে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ঋণ নেয়া থেকে বিরত ছিল- এ রকম নজিরও আছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি করেছেন। তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক গণনা পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঋণের শর্ত থাকতে পারে। এটা সব সময় নেতিবাচক নয়। আমরা ঋণ নিলে শর্ত মেনে নেব। তবে কোন কোন শর্ত মেনে নেয়া হবে, তা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, ঋণ নেবে সরকার। ঋণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সরকারের।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে, তা স্বাভাবিক নয়। প্রয়োজন নেই এমন অনেক খাতেও বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণ আমদানি হয়েছে, তা-ও অস্বাভাবিক। রেকর্ড আমদানির দায় পরিশোধের পাশাপাশি বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে দেশের ওপর চাপ বাড়বে। সংকট কাটাতে চলতি অর্থবছরে আরো বেশি বিদেশি ঋণ নিতে হবে। বড় বড় কিছু ঋণ আছে, এগুলো ২০২৪, ২০২৫ সালের মধ্যেই পরিশোধের চাপ আসবে। যদিও এর মধ্যে কিছু মেগা প্রকল্প চালু হবে, তাতে আয় বাড়বে। তবে প্রকল্পের আয় হবে দেশীয় মুদ্রায় আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে ডলারে। সুতরাং ডলারের ওপর চাপ আরো বাড়বে। এজন্য ঋণ পলিসিগুলো ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের টাকারও দরকার আছে। কাজেই আইএমএফ থেকে টাকা পাওয়া গেলে সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। তবে সরকার যদি মনে করে, বর্তমানে তারা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে সমস্যার সমাধান হবে বা বিশ্ববাজারে যদি কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে, তাহলে হয়তো ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হবে না।

এর আগে গত বছরের অক্টোবরে, আইএমএফ সারা বিশ্বে করোনার সংকট মোকাবিলায় ১৯০টি সদস্য দেশের জন্য ৬৫০ বিলিয়ন ডলার সমমানের এসডিআর (স্পেশাল ডাইং রাইটস) ঘোষণা করে। যার মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সরকার ওই সময় এসডিআর নেয়নি। কারণ সে সময় বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় ছিল। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক অস্থিরতায় চাপ বেড়েছে রিজার্ভে। তবে ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনেকটা নির্ভর করছে আইএমএফের দেয়া শর্তের ওপর। আগেরবার যখন আইএমএফ ঋণের প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন সঙ্গে ৩৩টি শর্ত জুড়ে দিয়েছিল, যার সবগুলোর সঙ্গে সরকার একমত ছিল না। এজন্য ঋণ নেয়ার বিষয়টি আর এগোয়নি। বরাবরই আইএমএফ বাজেট ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে থাকে। তাছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোসহ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার শর্ত থাকে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ থেকে সরকার প্রথমবার ঋণ নিয়েছিল ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে। এরপর ২০০৩-০৪, ২০১১-১২ এবং সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরেও তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হয়। তবে কোনোবারই তা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়নি। ১৯৪৫ সালে গঠিত আইএমএফের বর্তমান সদস্য ১৯০। ১৯৭২ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশ এর সদস্য। আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ বছরে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার যোগ্য।

ঋণের বিষয়ে দুই মন্ত্রীর ভিন্নমত : আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি এখনো স্বীকার করেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে তিনি তা সরাসরি উড়িয়েও দেননি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমরা আইএমএফের কাছে কোনো প্রকার অর্থ নেয়ার জন্য আবেদন করিনি। তারাও প্রস্তাব দেয়নি। অর্থমন্ত্রী বলেন, তাদের পরামর্শগুলো সরকারের জন্য উপকারী হয়। তারা সংস্কারপন্থি কিছু প্রস্তাব দেয়। তাদের পরামর্শগুলো দেশের জন্য ভালো হয়। তাদের প্রস্তাব পেলে আমরা গ্রহণ করি। তিনি বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিলেও দেশের স্বার্থ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এমন কোনো প্রকল্প বা ফান্ডিংয়ে যাব না, যেটা দেশের স্বার্থের পরিপন্থি হয়। নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অর্থ নেব না।

এদিকে একই দিন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশের প্রচুর তহবিল প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ডলার সংকট নিরসনে আইএমএফের কাছে সহায়তা চেয়েছি, তারা দিতেও রাজি। আইএমএফ শর্ত দিচ্ছে না। তারা শর্তের বিষয়ে উদারতা দেখিয়েছে। আইএমএফ আমাদের বাজেট সাপোর্ট দেবে। বাজেটের টাকা যে কোনো খাতে খরচ করা যায়। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়ে আমরা সহায়তা চেয়েছি।

তিনি আরো বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানির পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে যে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, আমরা তা সংস্থাটির কাছে তুলে ধরেছি। আইএমএফ সেই সহায়তা দিতেও প্রস্তুত। সেক্ষেত্রে তারা ডলার সংকটের কারণ জানতে চেয়েছে? তবে আমরা বলেছি ডলার সংকট বেশি দিন থাকবে না। কারণ গত বছর তিন লাখ শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিল, এবার সেটা বেড়ে ৯ লাখ হয়েছে। প্রবাসীরা ডলার পাঠাতে শুরু করলে সেই সমস্যা থাকবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App