×

মুক্তচিন্তা

মন্দিরে হামলা : শেষ কোথায়?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২২, ১২:৩০ এএম

মন্দিরে হামলা : শেষ কোথায়?

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর। শতাব্দীরও বেশিকাল স্থানটি অবিভক্ত ভারতজুড়েই খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিল- মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য রচনার ক্ষেত্রে। এছাড়াও শিক্ষা, দীক্ষা, দান-ধ্যান কী-না! আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি মির্জাপুরের গৌরবগাথা। ছোট মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম মির্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমসে পড়তে। বছর কয়েক আগে আদরের এক নাতনিকেও সেখানে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। সেখানকার ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দী আবার সমসাময়িক- একজন সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতাও। তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ কিন্তু সদা সক্রিয় স্কুলটির উন্নয়ন চিন্তায় মগ্ন। দিদি বলে ডাকি তাকে- যেমন সনজিদা খাতুনকে ডাকি সনজিদা দি বলে। সনজিদা দিও আজীবন শিক্ষক এবং ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন নেত্রী কিন্তু নিঃসন্দেহে উভয়েই দেশবরেণ্য। মির্জাপুর দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার স্মৃতি আজো অনেকটা ধরে রেখেছে তার বংশধরদের ও প্রতিভা মুৎসুদ্দীর কল্যাণে। ঘন ঘন না হলেও মাঝে মধ্যে পাবনা-ঢাকা-পাবনা যাতায়াতে কখনো কখনো দেখাও করি প্রতিভা দি’র সঙ্গে। অল্প সময়ের জন্য সাক্ষাৎ করলে কি আনন্দিতই না হন। দৃশ্যতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন কোন বইটা উপহার দেবেন- কী খাওয়াবেন এসব চিন্তায়। আর ওই বিশাল এলাকাটি কতই না শান্ত, স্নিগ্ধ ও পবিত্র!

সেখানে মন্দিরে হামলা : দেশের কর্তাব্যক্তিরা নিঃসন্দেহে সমগ্র জাতির কাছে প্রশংসার পাত্র। হিন্দুদের মন্দির ভাঙলে, পোড়ালে, বিগ্রহ ভাঙচুর করলে ধর্মের কোনো অবমাননা হয় না- বস্তুত কোনো অপরাধই হয় না। কিন্তু কোনো মসজিদের কাছে নোংরা-আবর্জনা থাকলে তা নিয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া মাত্র ‘ইসলামের অবমাননা’ হয় এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে ওই পোস্ট দাতাকে (যদি তিনি অমুসলিম হন) তৎক্ষণাৎ কারাগারে পাঠানো হয়। এতে সময় লাগে না আদৌ। কিন্তু পোস্টে কী আছে তা না দেখেই হাজার হাজার মানুষ মসজিদের মাইকের প্রচার শুনে গ্রামশুদ্ধ হিন্দু বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পোড়ানোর বহু ঘটনা ঘটলেও শাস্তি পেল পোস্টদাতা, শাস্তি দেয়া হলো না অপরাধীদের, যারা বাড়িঘর ভাঙল, পোড়াল, লুটপাট করল। এই ‘আদর্শ দেশ’-এর সর্বশেষ নমুনা বিগত ১৬ জুলাইয়ের কতিপয় দায়িত্বশীল দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে স্পষ্টভাবেই দেখানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে দুদিনের ব্যবধানে পৃথক দুটি ঘটনায় তিনটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর ও মন্দিরের অর্ধশতাধিক ফলদ গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৩ জুলাই বানাইল ইউনিয়নের ভুষুণ্ডি গ্রামের রথখোলা মন্দিরে এবং ১১ জুলাই পানিশাইল গ্রামে মন্দিরের জমি দখলকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় এলাকার দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। জানা গেছে, বানাইল ইউনিয়নের ভুষুণ্ডি গ্রামের রথখোলায় ৭৯ শতাংশ দেবোত্তর জমিতে রাধা গোবিন্দ ও কালী মন্দির রয়েছে। শত বছরের পুরনো এই মন্দির প্রাঙ্গণে বছরজুড়ে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ছাড়াও প্রতি বছর রথযাত্রা ও মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান হয়। মন্দিরে খোলা মাঠের মতো জায়গা থাকায় ছোট ছেলে-মেয়েরা সেখানে খেলাধুলাও করে। এদিকে মন্দিরের খোলা মাঠ দখলে নেয়ার জন্য ওই গ্রামের একটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে মন্দির কমিটির লোকজনের সঙ্গে বিরোধ করে আসছে। এ নিয়ে একাধিক মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে বলে জানা গেছে। শত বছরের পুরনো মন্দিরটি রক্ষায় পাকা বাউন্ডারি করার জন্য সরকার থেকে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সে কাজ করতেও অপর পক্ষ বাধা প্রদান করেছিল। পরে স্থানীয় প্রশাসন উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির সুরাহা করায় বাউন্ডারি নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এদিকে ওই গ্রামের আবুল খায়ের বকলির নির্দেশে তাদের লোকজন খোলা জায়গায় লাগানো ৫০-৬০টি উঠন্ত ফলদ গাছ কেটে ফেলে এবং রাধা গোবিন্দ ও কালী মন্দিরের কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ করেন মন্দির কমিটির প্রধান উপদেষ্টা জগদীশ চন্দ্র প্রামাণিক। এ ঘটনায় ওই এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ওই এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও গাছ কাটার অভিযোগে মন্দির কমিটির প্রধান উপদেষ্টা জগদীশ চন্দ্র প্রামাণিক বাদী হয়ে ১০-১২ জনের নামোল্লেখ করে মির্জাপুর থানায় অভিযোগ দেন। অভিযোগের বিষয়ে আবুল খায়ের বকলি বলেন, রথখোলা মন্দিরের সামনের মাঠটি যাতে খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হয় এবং এলাকার শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতে পারে এটা আমাদের দাবি। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মাঠে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করছে। মন্দিরের সামনে কাঠের গাছ কাটার কথা স্বীকার করলেও প্রতিমা ভাঙচুরের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান তিনি। অন্যদিকে একই ইউনিয়নের পানিশাইল (কদমতলি) গ্রামে ৩৮ শতাংশ জমির ওপর রাধা গোবিন্দ বিগ্রহ আশ্রম রয়েছে। ১১ জুলাই সকালে পূজা চলাকালীন ওই গ্রামের শুকুর আলী, খালেক মিয়া ও বাদল মিয়া জমি দখল করার জন্য মন্দিরটিতে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ করেন মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত সরকার। এ বিষয়ে ওই দিনই মন্দির কমিটির সভাপতি পলান বিশ্বাস মির্জাপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

অভিনব প্রচেষ্টা : অপরাধটা কী? মন্দিরের জমি দখল করতে না পেরে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর এবং অর্ধশতাধিক ফলদ গাছ কেটে নেয়া। যতদূর মনে পড়ে তাবৎ অপরাধ আইনত আমলযোগ্য এবং জামিনের অযোগ্য এবং গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এহেন অপরাধ তো ১০-২০ মিনিটে অকস্মাৎ ঘটানো যায় না। বিশেষ করে বিরোধটি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা আগে থেকেই আদালতে ঝুলছে। সেগুলোর মীমাংসা হয়নি। সেগুলো সবই আদালতে বিচারাধীন। এমতাবস্থায় লিখিত অভিযোগের তোয়াক্কা না করে ঘটনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। পুলিশ তা যায়নি। পুলিশের ন্যূনতম কর্তব্য ছিল অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো- অতঃপর তদন্ত করে সাক্ষী-প্রমাণ জোগাড় করে চার্জশিট দিয়ে বিচার কাজ শুরুর ব্যবস্থা করা। তা হয়নি। এমনকি, লিখিত অভিযোগকে এজাহার হিসেবেও এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত গণ্য করা বা রেকর্ড করে মোকদ্দমার নং, তারিখ ও অপরাধের ধারাগুলো যোগ করার ন্যূনতম কাজগুলো করা হয়নি। এমতাবস্থায় আপস ফয়সালার কথা কীভাবে এবং উদ্দেশ্যে ভাবা হলো? যতক্ষণ মামলা গ্রহণ না করা হয় ততক্ষণ অপরাধী তো অপরাধী বলে গণ্য হবেন না। তাই কর্তৃপক্ষ উভয়পক্ষকে সমান মর্যাদায় আসীন করতে চান বলে মনে হয়। তাতে কথিত অপরাধীদের সম্মানিত এবং যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন তাদের অপমানিতই করা হলো। এমন উর্বর মস্তিষ্ক কার তা বোঝা কষ্টকর। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর ছাড়া হাতে সংবাদপত্র পাব- এমনটা কি ভাবা যায়? যদিও এটা পুরোপুরি সত্য, সেলফ সেন্সরশিপ ও অপ্রকাশ্য সরকারি সেন্সরশিপ বা ডিজিটাল অপরাধের দায়ে ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে সব খবর পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায় না। তবু যেটুকু আসে- তাই যদি ৩৬৫ দিনের তথ্য একত্রিত করে প্রকাশ করা যেত তবে রীতিমতো রামায়ণ-মহাভারতের মতো ৮-১০টা ভলিউম হয়ে যেত। যেহেতু খবরগুলো সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি, তাই তেমন কোনো ভলিউম নিয়ে ভাবনারও অবকাশ নেই।

কী ঘটেছিল নড়াইলে? ফেসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নড়াইলের দিঘলিয়ার সাহাপাড়া গ্রামে হিন্দু বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার ঘটনায় আটক কলেজছাত্র আকাশ সাহা ও তার বাবা অলোক সাহাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ সাহা পুলিশকে বলেছেন, যে ফেসবুক আইডি থেকে ধর্মকে অবমাননা করে মন্তব্য করা হয়েছে, সেটি তার নয়। এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। এদিকে হামলার শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের দাবি, আকাশ সাহা ফেসবুকে ধর্মীয় কোনো পোস্টের নিচে এমন কোনো মন্তব্য করেননি, এটি পূর্বপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। সেই পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র অনুযায়ী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ফেসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ আকাশ সাহাসহ কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এছাড়াও সেখানকার মন্দিরের চেয়ার, সাউন্ডবক্স ভাঙচুরসহ ইট ছোড়ে বিক্ষুব্ধরা। তাতে মন্দির ও বিগ্রহের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এখন প্রশ্ন হলো- আকাশরা ভুক্তভোগী হয়েও পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কিন্তু যারা বাড়ির পর বাড়ি এবং মন্দির ভাঙচুর করল তারা দিব্যি আদরে বহির্জগতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কীভাবে? তারা কি ধর্মের অবমাননা করেনি?

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App