×

মুক্তচিন্তা

বন্ধুত্বের স্মারক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২২, ১২:২৯ এএম

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে আমরা গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের রাজনৈতিক সুবিধার বিষয়টি অসত্য নয়। এর জন্য পাকিস্তানিরাই দায়ী। ভারত কেবল সুযোগের মওকাটি অধিক বুদ্ধিমত্তায় গ্রহণ করেছিল। এ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’ বইতে এ সম্পর্কিত ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। ঘটনাটি এরূপ- আগরতলার মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে বৈকালিক চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়ে বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ, নন্দিনী সৎপথী এবং ড. ত্রিগুণা সেনের। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির লনে একান্তে আলাপে ড. ত্রিগুণা সেন বলেন, “ইয়াংম্যান, কাজ করে যাও। পহেলা নভেম্বর ১৯৭১ ঢাকায় বিজয় উৎসব হবে। জানো, ১৯৪৯ সালে আমরা ‘বাংলাদেশ সেল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। তখন থেকে আমি ওই সেল-এর দায়িত্বে। এতদিন পরে দুই নদীর স্রোত মিশেছে এক মোহনায়।” সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে বেলাল মোহাম্মদ বলেছেন, “স্যার আমি পাকিস্তান বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাজ করতাম। ‘সিগনিফিক্যান্ট’ নামে একটি কনফিডেন্সিয়াল তথ্য-পত্রিকা আমাকে দেয়া হতো কাউন্টার প্রোগ্রামের ডাটা হিসেবে ব্যবহারের জন্য। বলা হতো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারত চাইছে, কী করে পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়া যায়। আপনারা ১৯৪৯ সালে ‘বাংলাদেশ সেল’ গঠন করেছেন। তাহলে তো ওই ডাটাটি মিথ্যা নয়।” ড. ত্রিগুণা সেন অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। বেলাল মোহাম্মদকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “ছি, এসব বলতে নেই, খোকা।” অক্টোবর মাসে ড. ত্রিগুণার সঙ্গে বাংলাদেশ মিশনের সামনে পুনরায় সাক্ষাৎ হলে কুশল বিনিময়ের পর বেলাল মোহাম্মদ বলেন, ‘আপনি বলেছিলেন পহেলা নভেম্বর ঢাকায় বিজয় উৎসব হবে। আর তো দশ-পনেরো দিন বাকি পহেলা নভেম্বরের। লক্ষণ কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’ কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন ড. ত্রিগুণা সেন। নিজের বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তো আর জ্যোতিষীর মতো ভবিষ্যদ্বক্তা নই। সেটা ছিল পলিটিক্যাল এজাম্পশন। যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি অহরহ পরিবর্তন হয়েই থাকে। তবে এখন আবার বলছি, পহেলা নভেম্বরের আর বিলম্ব নেই। কিন্তু মিডল অব ডিসেম্বর? আশা করি এর মধ্যে পর্যাপ্ত সময়ের মার্জিন আছে। ওয়েট এন্ড সি।’ এই ঘটনার পাশাপাশি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত কর্নেল শওকত আলীর বইতেও তিনি লিখেছেন, ‘আগরতলা মামলা মিথ্যা ছিল না’। ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তান ভাঙা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল। ভারতের সেই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করেছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকার, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সামরিক নেতৃবৃন্দ। দেশভাগে পূর্ববাংলা ভাষা-সংস্কৃতির বৈপরীত্যে পাকিস্তান রাষ্ট্র বিলীন হয়ে যাবে না সেটা ভারতীয় রাজনীতিবিদরা পূর্বেই অনুধাবন করেছিলেন। অথচ পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ব বাংলার জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার জনমানুষের আকাক্সক্ষার মূলে ছিল শোষণ, বঞ্চনা, জমিদার-মহাজনদের উৎপীড়ন থেকে মুক্তি। বাস্তবে পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার মানুষের মর্ম উপলব্ধি না করে পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশ রূপে গণ্য করা শুরু করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার থেকেই বাঙালি জাতির পাকিস্তান বিদ্বেষী মনোভাব গড়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন সেই ক্ষোভের আগুনে ঘি-বর্ষণের ন্যায় বিভাজনটিকে সামনে নিয়ে আসে। পরিণতিতে জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। আমাদের এ যাবৎ কালের সব শাসক দলই নিজেদের জাতীয়তাবাদী রূপে জাহির করে এসেছে। অথচ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের মীমাংসা কিন্তু হয়ে গিয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় কর্তৃত্ব কারো অজানা নয়। আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের শাসকদের ভারতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা মোটাদাগে লক্ষ্য করা যায়। ভারতে হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের শাসনামলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রবল চাপের মুখে। সংখ্যালঘু নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে বিজেপির নানামুখী তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে আমাদের মৌলবাদীরা সক্রিয় হয়ে উঠবে না- তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমাদের মৌলবাদীরা সুযোগটি গ্রহণ করতে বিলম্ব করবে না। অপরদিকে আমাদের মৌলবাদীরা চাঙা হয়ে উঠলে ভারতীয় মৌলবাদীদেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে ভারতের সংখ্যালঘু নির্মূলে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে আমরা একই রাষ্ট্রের অধীনে ছিলাম। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দুবার রাষ্ট্রের বদল ঘটেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। সে অর্থে ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র এবং নিকট প্রতিবেশী। তবে দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভালো নয়। ভারতের শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎ বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। তবে প্রভুত্ব জাহির করতে কিন্তু ভোলেনি। ভারত তার দুর্বল প্রতিবেশীদের প্রতি সুবিবেচনা-সুবিচার করতে পারেনি বলেই প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনগণ ভারত-বিদ্বেষী হয়ে পড়েছে। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া কোনো প্রতিবেশী দেশের সরকারের সঙ্গে ভারতের মধুর সম্পর্ক নেই। নেপালের জনগণ ভারত অনুগত নেপাল কংগ্রেস দলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করায় দলটির অস্তিত্ব এখন প্রবল সংকটের কবলে। প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বন্ধুত্বের বিপরীতে বরাবরই প্রভুত্ব জাহির করে এসেছে। সে কারণে ভারত প্রতিবেশী কারো বন্ধু হতে পারেনি। ভারতের শাসক শ্রেণি-আমলাতন্ত্র এবং ভারতীয় জনগণ কিন্তু এক বা অভিন্ন নয়। ভারতীয় জনগণও নিজ দেশের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন উপায়ে। শোষণ-বঞ্চনা অবসানে আমাদের ন্যায় ভারতীয় জনগণও তাদের অব্যাহত সংগ্রাম জারি রেখেছে। শ্রেণি সংগ্রাম, জাতিগত সংগ্রাম কম-বেশি বিভিন্ন রাজ্যে চলমান। যেটিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যা দিয়ে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী কঠোর হস্তে দমন-পীড়ন চালিয়ে এসেছে। ভারতীয় জনগণ এবং আমাদের জনগণের সার্বিক অবস্থা তথৈবচ। দুই দেশের জনগণের সংগ্রাম নিজ নিজ পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী চলছে এবং চলবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্কও গড়ে উঠবে সংগ্রামের যোগসূত্রতায়। দুই দেশের জনগণের চলমান সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ঐক্য গড়ে উঠবে। এই ঐক্য যাতে গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী অতিমাত্রায় সচেতন। তাই দুই দেশের জনগণের সম্পর্ক-সম্প্রীতির উন্মুক্ত দুয়ার রুদ্ধ করতে সদা তৎপর। সঙ্গত কারণেই আমরা ভারতের কাছে নির্মোহ বন্ধুত্বের প্রত্যাশা করতে পারি না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে ভারত আমাদের মিত্র-বন্ধু হিসেবে থাকবে, সেটাই ছিল প্রত্যশিত। কিন্তু ভারত আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ না করে বিপরীতে ক্রামাগত প্রভুত্ব জাহির করে এসেছে। তাই প্রশ্ন জাগে ভারত যদি প্রভু না-ও হয় তবে বন্ধু কি?

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App