×

জাতীয়

এত আয়োজনেও কমছে না ডেঙ্গু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২২, ০৮:৩৯ এএম

সারাদেশেই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। হাসপাতালগুলোয় বাড়ছে রোগীর ভিড়। রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকবিলায় কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে দুই সিটি করপোরেশন। অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, কীটনাশক ছিটানো, ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, চিরুনি অভিযান, মশা গিলতে নালানর্দমায় গাপ্পি মাছের চাষ, ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু, প্রচারণামূলক সভা-সমাবেশ, পোস্টার-র‌্যালি কর্মসূচি, মশার অস্তিত্ব খুঁজতে ড্রোনের মাধ্যমে সার্ভেসহ কোনো চেষ্টারই কমতি নেই। তবে এত আয়োজনেও কেন নিয়ন্ত্রণহীন ডেঙ্গু? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন নগরবাসী। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সব চেষ্টাই চলছে, দাবি করে সিটি কপোরশেন বলছে, জনগণ সচেতন না হলে কার্যকর ফল মিলবে না।

দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৭৮৯ জন। এ বছর মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে মোট ৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোট ভর্তি ২৩৪ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে ১১৭ জন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার হাসপাতালগুলোয় ভর্তি ৩২ জন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার হাসপাতালে ভর্তি ১৪৪ জন।

২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। সে বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রথম ৫ মাসে ৩২৪ জন রোগী ছিল। গত বছর দেশে ২৮ হাজার ৪২৯ জন রোগী শনাক্ত হয়। যার মধ্যে প্রথম ৫ মাসে রোগী ছিল মাত্র ১০০ জন। ২০১৯ ও ২০২১ সালের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি বছর রোগীর সংখ্যা বেশি। অথচ মশা মারতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখেছে দুই সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসির চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৮৫ কোটি টাকা এবং ডিএসসিসির বরাদ্দ ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মূল কাজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে সিটি করপোরেশন লোক দেখানো কর্মসূচিতে ব্যস্ত- এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আমাদের এখানে শুধু মৌসুমভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সারা বছর কাজ না করার কারণে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যায়; তাই ডেঙ্গু রোগীও বাড়ছে। জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, সিটি করপোরেশন গতানুগতিক কাজ করছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা আমি দেখছি না। ঢাকায় নির্মাণাধীন ভবনে এডিসের লার্ভা বেশি। সিটি করপোরেশন এসব জায়গায় জরিমানা করে। তবে শুধু জরিমানা করলেই হবে না। লোকজনকে যত দিন না সচেতন করা যায়, তত দিন কাজ হবে না। তাছাড়া সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো জরিপ

ব্যবস্থা নেই। তারা মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপের ওপরই নির্ভর করে। ফলে যে জরিপ করা হয়, সেখানে কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। তাই এডিস মশার সঠিক চিত্রও পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, মশা মারার জন্য যেসব ওষুধ কেনা হয়, সেগুলো কার্যকর কিনা এবং সেগুলো ঠিকমতো প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, তা তদারকি হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের অধীনে নতুন কিছু ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। উপযুক্ত লোক দিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভালো জরিপ করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে হয় না।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিলে এ কাজে গতি আসবে না বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেছেন, এই চ্যালেঞ্জটা সিটি কপোরেশনগুলো কতটা নিতে পেরেছে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তাছাড়া এসব সংস্থা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আধুনিক যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা শুধু প্রচারের জন্য নয়, সত্যিকার অর্থে কতটা কার্যকর হলো সেই দিকে নজর দিতে হবে।

ওই কীটতত্ত্ববিদ আরো বলেন, গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে। বিষয়টি সিটি করপোরেশনকে জানালেও তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কতটা তৎপর ছিল, তা বোঝা যেত যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকত। কিন্তু আমরা তেমন কিছু দেখছি না। এখানে মনিটরিং ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। কারণ সঠিকভাবে তা হচ্ছে না। যথাযথ মনিটরিং হলে ঘাটতির জায়গাটা সহজে বের করে সঠিক ব্যবস্থা নেয়া যায়। এডিস নিয়ন্ত্রণে সিটি কপোরেশনকে সারা বছর কাজ করার আহ্বান জানিয়ে এ কীটতত্ত্ববিদ বলেন, কিউলেক্স ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আলাদাভাবে অভিযান চালাতে হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশন এই কাজগুলো সারা বছর করে না। তবে শুধু সিটি কপোরেশনের একার পক্ষে পুরোপুরি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; যদি এখানে নগরবাসীর সম্পৃক্ততা না থাকে।

করপোরেশন বলছে চেষ্টার কমতি নেই : পরিস্থিতি যা-ই হোক ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চেষ্টার কমতি নেই বলে দাবি দুই সিটি কপোরেশনের। দুই সংস্থার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মশা মারতে শুধু ওষুধ ছিটানোকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্য পদ্ধতিগুলো সমন্বয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জরিপ ও নিরীক্ষণ জোরদার, গবেষণাগার ও র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠনের পাশাপাশি বিশেষ পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম পরিদর্শন ও তদারকির জন্য মশক নিধন সেল গঠন করা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান ডিএনসিসির : ডেঙ্গু পরিস্থিতি ঠেকাতে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ডিএনসিসি। জানতে চাইলে সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জোবাইদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, অন্যান্য আধুনিক দেশের দিকে তাকালে বোঝা যাবে তাদের তুলনায় আমাদের ডেঙ্গু অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এরই মধ্যে ডেঙ্গু সম্পর্কিত যে কোনো অভিযোগের জন্য কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। উত্তর সিটির প্রতিটি জলাশয়ে আমরা মশার ডিম ও লার্ভা কমাতে গাপ্পি মাছ ছেড়ে দিয়েছি। এই মাছ মশার ডিম বা লার্ভা খেয়ে ফেলে। যার ফলে মশা জন্মাতে পারে না এবং ড্রেনের পানি পরিষ্কার থাকে।

তিনি বলেন, এডিস মশা জন্মায় বাড়ির ভেতরে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে। এসব জায়গায় নোভালুরন ট্যাবলেট দিয়েছি লার্ভা নষ্ট করতে। তিন মাস পর্যন্ত এই ট্যাবলেটের কার্যকারিতা থাকে। তবে তিন মাস অপেক্ষা না করে এক মাস পরই আবারো ট্যাবলেট দিচ্ছি।

তিনি বলেন, সব নির্মাণাধীন ভবনকে আওতায় এনেছি। রিহ্যাবের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছি। তারা কী কী কাজ করেছে, তার ফিডব্যাক নিয়েছি। আলাদা ডাটাবেজ তৈরি করে কাজ করছি। অনেক ভবনকে জরিমানা করেছি। আগে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যেত। এখন ১০০ বাড়ির মধ্যে তিন-চারটাতেও লার্ভা পাওয়া যায় না। এছাড়াও ‘মসকিউটো ট্র্যাপ’ প্রযুক্তি বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে এটার পাইলটিং করছি। মানুষের ঘামের গন্ধে মশা আসে। আমরা যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি, এর গন্ধেও মশা আসে। এই প্রযুক্তি দিয়ে গন্ধের মাধ্যমে মশা সব এক জায়গায় চলে আসবে। আমরা সচেতনভাবে কাজ করছি। তবে সবাই নিজ জায়গা থেকে সচেতন না হলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

পরিস্থিতি এখনো সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে দাবি ডিএসসিসির : ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও তা এখানো সহনীয় পর্যায়েই রয়েছে, এমন দাবি করছে ডিএসসিসি। জানতে চাইলে সংস্থার প্রধান নির্বাহী ফরিদ আহাম্মদ বলেন, আমাদের রুটিন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। প্রতি ওয়ার্ডে ১৩ জন করে দৈনিক ১ হাজার ৫০ জন কাজ করছেন। সকালে লার্ভি সাইট প্রয়োগ করা হয় এবং বিকালে ফগিং করা হয়। ভ্রাম্যমাণ অভিযান চলছে। তাছাড়া আলাদা ডাটাবেজ তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব এলাকা ঝুঁকিযুক্ত চিহ্নিত করেছে, সেই এলাকা ধরে কাজ করা হচ্ছে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সবার পরামর্শ নিয়ে সারা বছর কাজ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এডিস মশার ডিম এক বছর পর্যন্ত থাকে। সেসব বিষয় মাথায় নিয়েই আমরা কাজ করছি। ডেঙ্গু যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। শতভাগ সূচি নিয়ে কাজ করলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন শুধু ২৫ শতাংশ অবদান রাখতে পারে। বাকি ৭৫ শতাংশ অবদান রাখতে হবে অন্যান্য বিভাগ ও জনগণকে।

আপনারা বলছেন যে সব ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন, কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের কারণে কিন্তু ডেঙ্গু সহনীয় পর্যায়ে আছে। নইলে আরো খারাপ অবস্থার দিকে যেত। জনগণ শতভাগ সচেতন হলেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অন্যথায় নয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ : শুধু নগরবাসী নয়, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় বেশি ডেঙ্গু মশার উৎপত্তি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সারাদেশে ১ হাজার ৪০০ রোগীর মধ্যে ঢাকার রোগী ১ হাজার ৩০০ মতো (৯৩ শতাংশ)। গত সোমবার বিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে ডেঙ্গু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু রোগী কোথা থেকে আসছে, তা আমরা জরিপ করে দেখেছি, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এখানেই মশা বেশি জন্মাচ্ছে।

বাসিন্দাদের ক্ষোভ : রাজধানীর কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল-বিকাল ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও তা ছিটানো হচ্ছে না। রামপুরা এলাকার কাজী মাহবুব বলেন, বাসায় দিনে তিনবার নিজস্ব ফগিং দিয়ে স্প্রে করি। এরপরও মশার অত্যাচারে থাকা যায় না। দিন-রাত একাধিক কয়েল জ¦ালিয়ে রাখতে হয়। সিটি কপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে বাড়তি নজর দেয়া উচিত। ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা ফিরোজা বেগম বলেন, টিভিতে দেখি ডেঙ্গু মৌসুমে মশা মারতে এত আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ তো দেখছি না। মশা তো কমছে না। সিটি করপোরেশনের উচিত হবে কেন মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না, সে বিষয়ে ভালো করে গবেষণা করা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App