×

মুক্তচিন্তা

ঈদ আনন্দ, অতঃপর প্রসঙ্গ বিচিত্র ঘটনা-দুর্ঘটনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২২, ০১:৪৪ এএম

সড়ক, রেল ও নৌপথে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘœ করতে ঈদের আগে ও পরের কয়েকটি দিন বাধ্যতামূলক অনলাইন অফিস চালু করলে ত্রিবিধ পথের পরিবহনগুলোয় যেমন চাপ কমবে তেমনি জনভোগান্তিও লাঘব হবে। পাশাপাশি, ডিজিটাল বাংলাদেশের কার্যকারিতাও প্রমাণিত হবে। করোনাকালে আমরা সরকারি প্রজ্ঞাপনে কখনো ২৫ ভাগ কখনো ৫০ ভাগ জনবল নিয়ে অফিস পরিচালনা করতে দেখেছি। সে সময় অনেকে অনলাইন অফিস এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যেও অভ্যস্থ হয়েছিলেন। আমরা বারবারই দেখি ঈদের সময় রাজধানী থেকে প্রায় ১ কোটি মানুষ নাড়ির টানে গ্রামে যান আবার অল্প কদিনের ছুটি শেষে রাজধানীতে ফিরে আসেন। এই আসা-যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পরিবহনে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। বাস, ট্রেন ও নৌযানে মানুষের এত ব্যাপক চাপ পড়ে যে, তখন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে অন্যায্য ব্যবসায়ও মেতে ওঠেন। এবার ঈদেও সেই একই চিত্র আমরা দেখলাম। দেখলাম কোথাও কোথাও বাসের ভাড়া ১০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এও দেখা গেছে যে, বারো ঘণ্টার বেশি বিলম্বে ট্রেন ছাড়লেও যাত্রীদের তা না জানানোর ফলে সারা রাত স্টেশনে চরম ভোগান্তি ও অস্বস্তির মধ্যে সময় কাটাতে হয়েছে! বর্তমান সরকারের ডিজিটালাইজেশনের যুগে সাধারণের এরূপ ভোগান্তি কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে রেলওয়ের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা উচিত। দুই. ঈদে গ্রামে যাওয়া মানুষের এরূপ ভোগান্তি দেখে সরকারের সমালোচনা করে বিএনপি বলেছে দেশের মানুষের মনে শান্তি নেই, তারা ঈদ উদযাপন করতে পারছে না। সরকারের ব্যর্থতায় সড়কের বেহাল অবস্থা- মানুষের ভোগান্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দেশে কুরবানির যে পরিসংখ্যান আমরা জানতে পেরেছি তা গত বছরের হিসাবকেও ছাড়িয়ে গেছে। আমরা জানি, সিলেট অঞ্চলে বন্যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কুরবানির সংখ্যা কম হওয়ার শঙ্কা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা দেখলাম অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে! পর্যটনের দিকে তাকালেও দেখা যাবে দেশের মানুষের মধ্যে অশান্তি বা অস্বস্তি খুব বেশি নেই- যতটা বিএনপির আছে! অর্থাৎ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে- এরূপ মন্তব্য অনায়াসে করা যায়। বিগত কয়েক বছরের ঈদ পর্যালোচনা করলে বিএনপির একই বক্তব্য যে কোনো ঈদের জন্য প্রযোজ্য বলেও উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু ঈদ আনন্দ উপভোগ শেষে মানুষের নির্বিঘœ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে বিএনপির নেতিবাচক কোনো বক্তব্য শুনতে পেলাম না, এটাই আশ্চর্যের! জাপানের মতো দেশে নির্বাচনী প্রচারণাকালে কোনো রাজনীতিক খুন হবেন তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সমগ্র বিশ্বের মতো আমরাও অবাক হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি! জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। শিনজো আবে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি তার আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের উন্নয়নে তার সরকারের সহযোগিতা আমাদের যেমন আকৃষ্ট করেছে তেমনি ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় অন্যান্য বিদেশির মতো কয়েকজন জাপানি নাগরিক নিহত হলেও বাংলাদেশের প্রতি তার ইতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাননি। বরং সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। তার নির্মম মৃত্যুতে বাংলাদেশ গভীরভাবে শোকাহত হয়েছে। একই সঙ্গে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়োগে বাংলাদেশ ও দেশের জনগণ মর্মাহত ও বিমর্ষ হয়েছে।
তিন. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা এখনো বেজেই চলেছে। বিগত কয়েক মাসে সমরাঙ্গনে যুদ্ধের তীব্রতা আগের চেয়ে তেমন একটা না বাড়লেও বিশ্ব সেই যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে পারছে না। এক কথায় সমগ্র বিশ্বই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষও। না, কেবল রাশিয়া বা ইউক্রেনের সাধারণ মানুষই নয়- সমগ্র বিশ্বের সাধারণ মানুষ এই যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যুদ্ধের অবসান না হওয়া পর্যন্ত সাধারণের এই ভোগান্তি হ্রাস পাবে বলে আশা করাও কঠিন। এই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কোনো কোনো দেশকে সরাসরি প্রভাবিত করছে- কোনো কোনো দেশ পরোক্ষভাবেও সেই প্রভাবের উত্তাপে জর্জরিত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী জ্বালানির সরবরাহ চেইনে প্রভাব ফেলছে, প্রভাব ফেলছে জ্বালানির মূল্যেও। সেই সঙ্গে অতি আবশ্যিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়েও বিভিন্ন দেশ হিমশিম খাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির নাজুক পরিস্থিতি মোকাবিলায় একদিকে যেমন হিমশিম খাচ্ছে অন্যদিকে তেমনি ডলারের বিপরীতে ইউরোর শক্তি-শৌর্য হ্রাসে ইউরোপও ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে পারছে না। আবার ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ায় রাশিয়া সম্প্রতি সংস্কারের কারণ দেখিয়ে পাইপ লাইনে ইউরোপের কয়েকটি দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। পাইপ লাইনের এই সংস্কার (!) শেষ পর্যন্ত যদি গ্যাস সরবরাহে রাশিয়ার ‘অজুহাত’ হয়ে দেখা দেয় তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি যে আরো জটিল হবে সন্দেহ নেই। প্রাথমিকভাবে আপাতত ১০ দিনের সময় নিলেও কোনো কারণে এই সময় বৃদ্ধি পেলে ইউরোপে যে চরম জ্বালানি সংকট দেখা দিবে তাও উল্লেখের অবকাশ রাখে না। চার. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বাজারসহ বৈশ্বিক অস্থিরতা সৃষ্টি করায় আমরাও তার ফলভোগ শুরু করেছি। মুদ্রাস্ফীতির ধারাবাহিকতা কয়েক সপ্তাহ ধরে অব্যাহত রয়েছে। উপরন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গত দুই বছরের তুলনায় বেশ খানিকটা হ্রাস পেয়ে গেছে। এমতাবস্থায় সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণে তৎপর হয়েছে। আড়াই বছর করোনা অতিমারির মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখায় সরকার যথেষ্ট সক্ষমতা দেখিয়েছে, সক্ষমতা দেখিয়েছে মহামারি নিয়ন্ত্রণেও। আমরা আশা করব সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি থেকেও সাফল্য আসবে- যা আমাদের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হবে। পাঁচ. তীব্র জনবিক্ষোভের মধ্যে ১২ জুলাই ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কৌশলে নিজে প্রেসিডেন্সি ধরে রেখেই দেশ ছেড়ে প্রথমে প্রতিবেশী মালদ্বীপ এবং পরে সেখান থেকে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন গোটাবায়া রাজাপাকসে। এখন পর্যন্ত জানা গেছে তার গন্তব্য জেদ্দা। জন-অসন্তোষকে উপেক্ষা করে তার এই কৌশল গ্রহণ শ্রীলঙ্কাবাসীকে আরো ক্ষুব্ধ করেছে, আহত করেছে। তাই সিঙ্গাপুর থেকে ই-মেইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ বার্তা পাঠালে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উল্লাস দেখা গেছে। রনিল বিক্রমাসিংহের সরকার সেখানকার পরিস্থিতি সামাল ও স্বাভাবিক রাখার জন্য কারফিউ জারিসহ সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে যা করণীয় তাই করার নির্দেশ দিয়েছে। গণ-আন্দোলন একবার দানা বেঁধে উঠলে জরুরি আইন প্রত্যাখ্যান করাও বিক্ষোভকারীদের সম্ভব হয়ে ওঠে। রাজাপাকসের পদত্যাগের খবর সমগ্র বিশ্বের গণমাধ্যমে চাউর হওয়ার পরও নির্দিষ্ট দিনে তিনি ক্ষমতা না ছেড়ে রনিলকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন করায় আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমরা সরকার ও বিরোধী সব পক্ষের কাছে প্রত্যাশা করব যেন কোনো অঘটন না ঘটে। ধৈর্যের সঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতির সন্তোষজনক সমাধান নিশ্চিত হোক এটাই আমরা দেখতে চাই। ছয়. আমাদের দেশে একদল মানুষ আছেন যারা শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সংকটকে ইস্যু করে বাংলাদেশেও সরকার পতনের কল্পনা করতে ভালোবাসেন। এরা এর আগে আফগানিস্তান ইস্যুতেও খুশিতে ডগমগ হয়েছিলেন! ভারতে যখন কংগ্রেস পরাজিত হয় তখনো এই গোষ্ঠীর দলভুক্তরা আনন্দে মেতে উঠেছিল! তারা আশা করেছিল নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে ভারতের কংগ্রেসের মতো বাংলাদেশের আওয়ামী লীগেরও রাশ টেনে ধরবেন! এরকম অন্তহীন অলীক ভাবনায় একদল মানুষ দুঃস্বপ্নে মেতে ওঠে! এদেরই কেউ কেউ আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও উত্তপ্ত করে ফেলে! ভাবখানা এমন যে, তাদের তাপেই ‘খই ফোটা’ শুরু করবে- অর্থাৎ মানুষ হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে এসে আওয়ামী লীগকে ফুঁ দেবে আর আওয়ামী লীগের সরকার সেই ফুঁয়ের ঝড়ে উড়ে যাবে! যারা ভাবেন বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার মতন হবে তারা আসলে কী চান জানি না। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হলে তাদের লাভই বা কী তাও আমাদের বোঝার নেই! তাই আপাতত তাদের উদ্দেশ্যে শুধু বলব স্বপ্নের মধ্যেই পোলাও-মাংস খেয়ে তৃপ্ত থাকুন! চলমান বৈশ্বিক মন্দায় কোনো দেশকে যেন শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করতে না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সাত. ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন বর্ষাকাল- আষাঢ় ও শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল! আষাঢ় শেষে এসেছে শ্রাবণ। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে, বাতাসের দিকে তাকিয়ে ভাদ্র-আশ্বিনের তেজ টের পাচ্ছি। প্রকৃতির বিরূপ আচরণেই বর্ষাকালে বইছে এরূপ দাবদাহ। আবহাওয়াবিদদের মতে দেশে মৃদু তাপপ্রবাহ চলছে। কার্বন নিঃসরণ, গ্রিন হাউস গ্যাস, উন্নত অনেক দেশের নানাবিধ বৈজ্ঞানিক ও পারমাণবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সমগ্র বিশ্বই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাবে জর্জরিত। ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি। সমগ্র ইউরোপেও চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। কোথাও কোথাও দাবানলে জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছে বিস্তৃত বনভূমি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা ও বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য ছোটবড় ধনীদরিদ্র সব দেশকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App