×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষকদের এখন নিয়মিতভাবেই ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হচ্ছে!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২২, ০৬:১৩ এএম

শিক্ষা কাকে বলে, শিক্ষা কত প্রকার ও কী কী প্রভৃতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমাজে জারি আছে। পণ্ডিত, গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও শিক্ষা নিয়ে নানান বক্তব্য, নানান মতবাদ ও মতভেদ আছে। কিন্তু এসব প্রচলিত এবং সনাতন শিক্ষার বাইরে সমাজে ‘উচিত শিক্ষা’ বলে এক ধরনের শিক্ষার প্রচলন আছে। এ ‘উচিত শিক্ষা’ বড় কঠিন শিক্ষা, যা চরিত্রগতভাবেই বর্বর, যা সাধারণত শিক্ষকবর্গের লোকেরা এসব শিক্ষা দেন না বরঞ্চ এখন শিক্ষকদেরই নিয়মিতভাবে এসব ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হচ্ছে। কাউকে ‘দেখে নেয়া’র কথা বলে সময় ও সুযোগ বুঝে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার তরিকা সমাজে ‘উচিত শিক্ষা’ নামে জারি আছে। এক ধরনের প্রতিশোধপরায়ণ মনোবৃত্তি থেকে সমাজে ‘উচিত শিক্ষা’ নামে অদ্ভুত এক ঘটনার অনুশীলন জারি আছে। সেটা কাউকে সবার সামনে অপমান করা হতে পারে, আত্মসম্মানে আঘাত করা হতে পারে, মেরে হাত-পা ভেঙে দেয়া হতে পারে কিংবা খুন করা বা পিটিয়ে মেরে ফেলাও হতে পারে। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিপক্ষকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হয়। কিছুদিন ধরে আমরা লক্ষ করছি, গোটা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকদের ধরে ধরে এখন ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি এমন নয় যে, শিক্ষকদের শিক্ষার ঘাটতি পড়েছে; শিক্ষকরা ঠিকমতো শিক্ষা প্রদান করছেন না; কিংবা শিক্ষকরা অনুচিত শিক্ষা দিচ্ছেন! সুতরাং তাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া উচিত! অধিকন্তু শিক্ষকদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার জন্য তার গলায় জুতার মালা পরানো, শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করানো কিংবা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে একের পর এক শিক্ষকদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হচ্ছে। সমাজের মূল্যবোধ এবং শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা কোন পর্যায়ের অধঃপতন হলে সমাজে শিক্ষকদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হয়, সেটা সহজেই অনুমেয়। আমি বিগত জুলাইয়ের ১ তারিখ আমার এ কলামে লিখেছিলাম ‘শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা’ কি ‘মিথে’ পরিণত হয়েছে?’ আমি সে লেখাটি লিখেছিলাম পরপর দুটি ঘটনাকে সামনে রেখে। নড়াইলে একজন অধ্যক্ষকে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করা এবং আশুলিয়ায় শিক্ষার্থীদের লাঠির আঘাতে একজন শিক্ষকের মৃত্যু নিয়ে। সারাদেশে দুটি ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। আমি তখন শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছিলাম। আমি লিখেছিলাম, ‘শত শত বছর ধরে শিক্ষকের মর্যাদা সমাজের বিভিন্ন রীতিনীতির মতোই একটা মর্যাদার সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। কেননা, শিক্ষকের এ মর্যাদার বিষয়টি হুট করে আকাশ থেকে পড়েনি কিংবা মাটি থেকে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠেনি। সমাজের অভ্যন্তর থেকে শত শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় আমরা শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের নীতি-নৈতিকতার বোধ এবং উপলব্ধিতে প্রতিষ্ঠিত করেছি। অথচ কিছুদিন ধরে সামাজিকভাবে একের পর এক শিক্ষকদের যেভাবে অপমান, অপদস্থ এবং অমর্যাদা করা হচ্ছে, তাতে করে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিনতিপাত করছি। বিশেষ করে আশুলিয়ায় একজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে যখন পিটিয়ে হত্যা করল, তখন একজন শিক্ষক হিসেবে ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। আমরা কোথায় আছি? আমরা কোথায় যাচ্ছি?… এ ঘটনা শুধু সাধারণ কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নয়। সভ্যতার অগ্রগতিকে টেনেহিঁচড়ে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা নিদর্শন হিসেবে এটাকে দেখতে হবে। তাই কেবল দোষীকে গ্রেপ্তার করে ধরে এনে বিচার দাবি করলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। এ সমাজকে নতুন করে রূপান্তরের পরিকল্পনা করতে হবে যেখানে সত্যিকার অর্থেই শিক্ষকের মর্যাদা সুরক্ষিত থাকবে।’ কিন্তু সারাদেশে তীব্র প্রতিবাদ হলেও সমাজের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই, আমরা দেখলাম গত ১৩ জুলাই রাজশাহী-১ আসনের এমপি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে এমপির কার্যালয়ে ডেকে এনে উপস্থিত সবার সামনে ১৫ মিনিট ধরে ‘বেধড়ক’ পিটিয়েছেন। অধ্যক্ষকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়েছেন। সংবাদপত্রের বরাত দিয়ে আমরা জানতে পারি যে, রাজশাহী জেলা কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা দাবি করেছেন, ভুক্তভোগী অধ্যক্ষের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। অধ্যক্ষের বরাত দিয়ে শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, আরো সাত-আটজন শিক্ষকের, অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের সামনে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী অধ্যক্ষকে কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় এবং একপর্যায়ে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়েছেন। মারধরের সময় অন্য অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা চুপচাপ ছিলেন। ‘উচিত শিক্ষা’ কাকে বলে! এমপি সাহেব একজন অধ্যক্ষকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়েছেন। এ ‘উচিত শিক্ষা’ কার্যক্রম নিয়মিতভাবেই চলছে সারাদেশে। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ পিয়ার সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রকাশ্যে সবার সামনে কান ধরে উঠবস করিয়ে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হয়েছিল। এ ঘটনা সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু শিক্ষকদের ‘উচিত শিক্ষা’ কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। আমরা দেখলাম, একের পর এক শিক্ষকদের নানাভাবে অপমান করা, লাঞ্ছিত করা, জেলে পুরে দেয়া, এমনকি হত্যার ঘটনা ঘটছে। মুন্সীগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঘটনা আমরা জানি। হৃদয় মণ্ডলকে জেলে পুরে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হয়েছিল। এ ‘উচিত শিক্ষা’ কার্যক্রমের সাম্প্রতিক নজির হচ্ছে, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে সবার সামনে অপমান করা। ‘উচিত শিক্ষা’ কাকে বলে! আর ঠিক তার পরের ঘটনা হচ্ছে, আশুলিয়ায় একজন শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষককে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়। ‘উচিত শিক্ষা’র চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখলাম। তারপর আমরা দেখলাম কক্সবাজারের পেকুয়ায় ক্লাস চলাকালীন সময়ে মাদ্রাসায় ঢুকে একজন শিক্ষিকাকে ইট দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে একজন দুর্বৃত্ত। শিক্ষিকার একেবারে ‘উচিত শিক্ষা’ হয়েছে! দেশব্যাপী চলমান এ ‘উচিত শিক্ষা’ কার্যক্রমের সর্বশেষ ঘটনা হচ্ছে, রাজশাহী ১-এর এমপি সাহেব ‘কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় এবং একপর্যায়ে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে’ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে ‘চরম শিক্ষা’ দেয়া। এটা নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি হবে। টেলিভিশনের টকশোতে টক-ঝাল-মিষ্টি আলাপ-আলোচনা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেসুমার হা-হুতাশ হবে এবং একদিন আমাদের দৃষ্টির অগোচরে চলে যাবে। ঠিক কিছুদিন পর শিক্ষকদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার চলমান কার্যক্রমের নতুন ঘটনা আমাদের সামনে এসে হাজির হবে। এভাবেই চলছে এবং চলবে। এবার অবশ্য রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেনকে। এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ তদন্ত কমিটি নানামুখী ক্ষমতার দৌরাত্ম্য, জ্ঞাতি-গোষ্ঠীজাত সম্পর্কের বেড়াজাল, নানামুখী ফরমাল-ইনফরমাল চাপ এবং অর্থনৈতিক অসমতার কমজোরিতে খুব একটা আলোর মুখ দেখে না। ফলে আমরা আশা করি এ কমিটি দ্রুততম সময়ে একটি নিরপেক্ষ এবং যথাযথ তদন্ত রিপোর্ট দেবে কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা সে আশার গুড়ে বালি ছাড়া কিছু দেখায় না। ফলে শিক্ষকদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার কার্যক্রমে ‘অত্যন্ত সক্রিয়তার সহিত’ এবং ‘নিষ্ঠার সঙ্গে’ অব্যাহত থাকবে এ বিষয়ে ‘সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই’। একজন শিক্ষক হিসেবে এর চেয়ে দুঃখের, কষ্টের, লজ্জার এবং গøানির আর কিছু নেই। যে সমাজ শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা দিতে জানে না, শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার সুরক্ষা দিতে জানে না, সে সমাজ কোনোভাবেই নিজেকে সভ্য সমাজ হিসেবে দাবি করতে পারে না। তাই চলুন আগে নিজেরাই নিজেদেরই প্রশ্ন করি, নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করি : এভাবে আর কত শিক্ষককে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হলে এ বর্বরতা এবং অসভ্যতার ইতি ঘটবে? এ সমাজ আর কত এ অসভ্যতা ও বর্বরতা সহ্য করবে? ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App