×

মুক্তচিন্তা

টিকটক : সামাজিক ব্যাধি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২২, ১২:২২ এএম

টিকটক : সামাজিক ব্যাধি

বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার নাম টিকটক। সারাবিশ্বে তরুণ প্রজন্মের কাছে অ্যাপটি খুব জনপ্রিয় হলেও অনেক সমালোচনা রয়েছে অ্যাপটি নিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটির ভিন্ন ব্যবহার থাকলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক। দেশের হাজারো কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ব্যবহার করছে অ্যাপটি। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো তারা অ্যাপটি ব্যবহার করছে অপ্রয়োজনীয় ও অশ্লীল ভিডিও তৈরিতে। সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বর্তমান সময়ের এক অপরিহার্য মাধ্যমে পরিণত হয়েছে টিকটক। নেট দুনিয়ায় নিজেকে সেলিব্রিটি বানানোর জন্য বিভিন্ন গানের অংশ, সিনেমা ও নাটকের ডায়ালগগুলোর সঙ্গে অভিনয় করে হাজার হাজার ফলোয়ার তৈরির চেষ্টা করছে তরুণরা। টিকটক ভিডিওর বেশিরভাগই অশ্লীলতা ও বিকৃত অঙ্গভঙ্গি দিয়ে ভরা। করোনা মহামারির সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অফুরন্ত সময় পায়। আর এই সময় তারা ব্যয় করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। খুব সহজেই টিকটক অ্যাপটি ব্যবহার করে ভাইরাল হওয়া যায়। ফলে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা অতি তাড়াতাড়ি অ্যাপটিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। এখন শুধু কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী নয়, গৃহবধূ থেকে শুরু করে ছোট্ট শিশুরাও এতে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ক্লাস থ্রি, ফোরের শিক্ষার্থীরাও নিজেদের ভাইরাল করার নেশায় মগ্ন। গত ৭ জুলাই নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা ফাঁসি দেয়ার টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে ফাঁস লেগে মারা যায়। যা অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। সানজিদার মতো এমন হাজারো শিশু-কিশোর আজ মারাত্মক এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। ভাইরাল হওয়ার আশায় যে কোনো ধরনের অশ্লীল ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিডিও ধারণ করছে। এমনকি ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে ভিডিও ধারণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুতেও অপ্রয়োজনীয় ও অশ্লীল ভিডিও ধারণ করতে দেখা যায়। পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু নিয়ে করা ভিডিও ও রাস্তার মাঝখানে মধ্যবয়সি এক নারীর নৃত্য টিকটকের অপব্যবহারের দিকটি নতুন করে সমালোচনা তৈরি করে। নিজেকে ভাইরাল করার নেশায় অপ্রয়োজনীয় এসব টিকটক ভিডিও করে চলছে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। শুধু তাই নয়, অ্যাপটি ব্যবহার করে অনেকে জড়িয়ে পড়েছে সাইবার অপরাধে। টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে অন্যকে ট্রল করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। অনেক রাজনীতিবিদ, শিল্পী এমনকি বিভিন্ন আলেমরাও তাদের ট্রলের শিকার হয়, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। অ্যাপটি তরুণ সমাজের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। জীবন্ত ভিডিওর কাছে বই এখন তাদের কাছে প্রাণহীন বস্তু ছাড়া কিছুই না। পড়ালেখায় দিন দিন অনীহা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। অনেকেই পরিবার, আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দিন-রাত সময় ব্যয় করছে টিকটক বানাতে। বেশি ফলোয়ার বানাতে, নেট দুনিয়ায় জনপ্রিয় হতে করে চলছে নোংরা প্রতিযোগিতা। আর এটি তাদের ধীরে ধীরে অনৈতিক করে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে আরো অনৈতিক কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যেমন- টিকটক ব্যবহার করে নারী পাচার করা। এমন পরিস্থিতি পুরো সমাজের জন্য এক অশনি সংকেত। বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে এসব অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখতে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও যেন এসব অনৈতিক কাজ থেকে নিরাপদ থাকে সেজন্যও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, বর্তমান টিকটক সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। তাদের মতে আউটডোরে খেলাধুলার সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় টিকটক নামক এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোর। বর্তমানে বাংলাদেশে সুস্থ বিনোদন চর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা যেন অবসর সময় কাটাতে পারে সেজন্য তাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চার সুযোগ করে দেয়া, পর্যাপ্ত খেলাধুলার জায়গার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। এছাড়া পরিবারের উচিত সন্তানদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করা, গঠনমূলক কাজে তাদের নিযুক্ত করা। সর্বোপরি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ টিকটক অ্যাপটি নিষিদ্ধ করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০২০ সাল থেকে অ্যাপটি বন্ধ আছে। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হওয়ায় র‌্যাব টিকটক ও লাইকির মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করার কথা বলে। গত বছর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী টিকটক, লাইকির মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করার জন্য একটি রিট আবেদন করেন। বর্তমান প্রজন্মের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী এই প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে। ঝরে যাবে সানজিদার মতো আরো অনেক প্রাণ। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেবেন বলে আশা করছি।

জহুরা শিকদার : শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App