×

মুক্তচিন্তা

ব্রিটেনে ঈদের ছুটি প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২২, ১২:২৩ এএম

ঈদ মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য একটা আনন্দঘন দিন। প্রতিটি মুসলমান পবিত্র এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে প্রতি বছর। সন্তান-পরিবার-স্বজন-সজ্জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর আকাক্সক্ষা থাকে এ দিনটাতে মানুষের। ঈদের দিনগুলো একটা বৈচিত্র্য নিয়ে আসে পোশাকে কিংবা খাবারে। দলবেঁধে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোলাকুলি কিংবা কুশল বিনিময়ের চিরচেনা চিত্রটি নিয়ে আসে ধর্মীয় মূল্যবোধের এক চিরন্তন বার্তা এই অভিবাসেও। দিন উজ্জ্বল হলে খোলা মাঠে (পার্কে) ঈদের নামাজের আয়োজন হয় লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে। তাছাড়া প্রতিটি মসজিদেই থাকে অন্তত তিনবার নামাজ পড়ার নির্ধারিত সময়। বৈচিত্র্যময় পোশাক পরে এখানে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোর-কিশোরীসহ প্রায় সবাই। আনন্দে উদ্বেল থাকে মানুষ। ঈদের দুটি দিনের এই উৎসবকে এদেশে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বিবেচনা করলেও এটা তাদের জীবনের অপরিহার্য সংস্কৃতি হিসেবে ধারণ করে ফেলেছে। কিন্তু এই চিরন্তন চিত্রটির মাঝেও আছে চাপা এক চিরচেনা মুখ বেজার করা চিত্র এই ব্রিটেনে। দেশটিতে বাস করা অর্ধমিলিয়নের বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মাঝেই থাকে এক চাপা কান্না কিংবা মুখ ভার করে থাকা দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাসটাও মূলত আমাদের কমিউনিটির ব্যবসায়ীদের ঘিরেই। এখানে যদি একটু ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে বেরিয়ে আসবে আমাদের কতিপয় মানুষগুলোর লোভ কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধহীনতার চিত্র। ১২ হাজারেরও অধিক রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আছে এই ব্রিটেন বাংলাদেশি মালিকানাধীন। এই রেস্টুরেন্টগুলোর সবই যে খুব ভালো ব্যবসা করে তা নয়, আর সে কারণে অধিকাংশ রেস্টুরেন্টেই মালিক নিজে ফুলটাইম কাজ করেন। অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের পরিচালক-মালিক মিলে এতে কাজ করেন কম হলেও ৭০ হাজারের মতো মানুষ। ৭০ হাজার মানুষের পরিবারে আছে কম করে হলেও ৩ লাখ মানুষ। এবং আরেকটা সত্য কথা হলো এই মানুষগুলোর মাঝে ৯৫ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর। কিন্তু‘ বাংলাদেশি এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘গাভনার’ (পরিচালক-মালিক) হয়েও তারা নিজেদের বঞ্চিত রাখেন তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতির উৎসবের আমেজ থেকে। অর্থাৎ অর্ধ মিলিয়ন বাংলাদেশি তাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং আনন্দের দিনে তার স্ত্রী-সন্তান কিংবা আত্মীয়দের সঙ্গে সময় দিতে পারেন না। রেস্টুরেন্টরে মালিক বলেন কিংবা কর্মী বলেন রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে হয় দিনটির বিকাল বেলায়, কাজের জায়গায়। স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ করা বিষণ্ন মুখ নিয়ে সেদিন সার্ভিস পেতে হয় রেস্টুরেন্ট গ্রাহকদের। বিশ্বময় মানুষের কল্যাণ কামনায় ব্রিটেনের দুই মিলিয়নের মতো মুসলমানও এই দুটি দিনে সুখ-সমৃদ্ধি আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে নিজেদের একীভূত করতে চান। কিন্তু‘ কাজের জাঁতাকলে বিকাল হওয়ার আগেই এ আনন্দ কেটে যায়। সকালে ঈদের নামাজ শেষে অনেককেই যেতে হয় নিত্যদিনের গন্তব্যে। অথচ বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করা ৭০ হাজার বাংলাদেশির ওই প্রতিষ্ঠানে মানুষগুলো চাইলেই বছরে এ দুটি দিন ছুটি দিতে পারেন। শুধু সদিচ্ছা, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধের দায় থেকে তারা এ কাজটি করতেই পারেন। এমনকি মালিকপক্ষের কেউ যদি মনে করেন, এ দুটি ছুটিতে বাড়তি একদিনের অর্থ তাদের বহন করতে হবে। তখন এ ছুটিকে তারা তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারেন। ‘যুক্তরাজ্যে ঈদে ছুটি চাই’ সেøাগানে ব্রিটেনের দুটি গণমাধ্যম যৌথভাবে একটা সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছে। ৫২বাংলাটিভি এবং সাপ্তাহিক পত্রিকার উদ্যোগে ইতোমধ্যে আলতাব আলী পার্কে সমাবেশ হয়েছে, চলছে গণসংযোগ। পাঁচ শতাধিক মানুষ এ আন্দোলনে শরিক হয়ে দেশটিতে ছড়িয়ে দিয়েছে এ সচেতনতার বার্তাটি। এতে সংযুক্ত হয়েছেন জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে এমনকি ক্যাটারিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বড় বড় ব্যবসায়ীও। একটা ব্যাপক সাড়া আছে এ আন্দোলনে। একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে ঈদের জন্য ছুটি নির্ধারিত আছে। শিক্ষার্থীরা দুটি দিন অনুমোদিত ছুটি নিতে পারে, কিন্তু স্কুল খোলা থাকে। আমেরিকার নিউইয়র্কের স্কুলগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে (অফিসিয়ালি) ঈদের দিনে ছুটি দেয়া হয়। আর সেজন্য আমরা যদি নিজেরা এই ছুটির সঙ্গে একাত্ম হতে না পারি, তাহলে স্থানীয়ভাবে অর্থাৎ সরকারের কাছে এ দাবি উত্থাপনের কোনো সুযোগ সৃষ্টি হবে না। উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটেনের ধর্মীয় উৎসব ক্রিসমাস দিনে কিংবা তার পরের দিন বক্সিং ডেতে সব রেস্টুরেন্টে সমান ব্যবসা হয় না। কোনো কোনো রেস্টুরেন্ট ক্রিসমাস ডেতে দিনের বেলায় খোলা হয়, শুধু পূর্বনির্ধারিত (বুকিং) ক্রেতাদের আপ্যায়ন করতে এবং বলতে গেলে বক্সিং ডেতে থাকে রেস্টুরেন্টগুলো একদম শূন্য। বাস্তবতার বিবেচনায়ই সেদিন অনেকেই রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখেন। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এই অভিবাসে আমাদের চ্যালেঞ্জ আছে হয়তো, কিন্তু এদেশের বাস্তবতায় বছরে দুটি দিনের ছুটিতে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কিংবা কর্মীরা কোনো ঝুঁকিতেই পড়বেন না বলেই আমরা বিশ্বাস করি। তাই ঈদের দুটি দিনে ছুটি দিতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এগিয়ে আসবেন, এই আশাটুকু করা যায়। বলা যায়, বাংলাদেশি তথা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ব্যবসায়ীরা যদি এ কাজে এগিয়ে আসেন, তাহলে জাতীয়ভাবেও এ দাবি উত্থাপনের যৌক্তিকতা পাওয়া যাবে।

লন্ডন থেকে

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App