×

সারাদেশ

এবার ঈদ আনন্দবঞ্চিত হাওরবাসী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২২, ০৮:৫৭ এএম

এবার ঈদ আনন্দবঞ্চিত হাওরবাসী

বানের পানিতে সহায়সম্বল হারিয়ে এবার ঈদুল আজহায় হাওরের বানভাসি মানুষের মুখে হাসি নেই। ছবি: ভোরের কাগজ

বানের পানিতে ভেসে গেছে সব কিছু

এবার ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হাওরবাসী। অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙে একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে এমনিতেই দিশাহারা ছিলেন হাওর জনপদের বাসিন্দারা। ফসল হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেখা দেয় বন্যা। প্রথম দফা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত ১৬ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে বিপর্যস্ত হয় হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ।

বন্যার পানি আর হাওরের ঢেউ সুনামগঞ্জবাসীর পুকুরের মাছ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গোলায় রাখা ধান ও বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিদ্যুৎ, মোবাইল যোগাযোগ, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে হাওরাঞ্চলে দেখা দেয় চরম দুর্যোগ। পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন হাওরবাসী। তাই এবার ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হাওরবাসী। এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন-

মো. সাজ্জাদ হোসেন শাহ্, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) : ‘আব্বা, আমারে একটা ফেন্ড (প্যান্ট) কিন্যা দিবা, আমার ফেন্ডা (প্যান্টটা) ছিঁড়্যা (ছিঁড়ে) গেছে।’ ছেলের এমন আবদার রক্ষা করতে পারেননি বাবা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নের মানিগাঁও গ্রামের দিনমজুর হযরত আলী। আবদার রক্ষা করতে না পারায় বাবার বাড়ি ছেড়ে দাদার বাড়ি চলে গেছে ১০ বছরের শিশু রিয়াদুল। রিয়াদুলের বাবা হযরত আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কাপড় কিনব ক্যামনে। অনেক দিন কাজকাম নাই, আয়-রোজগারও নাই। কোনো রকমে খেয়ে বেঁচে আছি।’ এমন অবস্থা শুধু তাহিরপুরেই নয়। হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার খেটে খাওয়া মানুষজনের মধ্যে ঈদের আনন্দের বদলে চলছে শুধু হাহাকার।

অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙে একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে এমনিতেই দিশাহারা ছিলেন হাওর জনপদের বাসিন্দারা। ফসল হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেখা দেয় বন্যা। প্রথম দফা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত ১৬ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে বিপর্যস্ত হয় হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সুনামগঞ্জ শহরের সব একতলা বাসায় পানি ঢুকে যায়।

প্লাবিত হয় জেলার জামালগঞ্জ, ধরমপাশা, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুরসহ ১২ উপজেলা। বন্যার পানি আর হাওরের ঢেউয়ে সুনামগঞ্জবাসীর পুকুরের মাছ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গোলায় রাখা ধান ও বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিদ্যুৎ, মোবাইল যোগাযোগ, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে হাওরাঞ্চলে দেখা দেয় চরম দুর্যোগ। পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন হাওরবাসী। বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রসহ স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা সরকারি অফিস-আদালতেও আশ্রয় নেন বানভাসিরা।

সরকার বানভাসি মানুষকে পুনর্বাসনের জন্য খাদ্যসামগ্রী, নগদ অর্থ, বাড়িঘর মেরামতের জন্য ঢেউটিন বিতরণ করেছে। এরই মধ্যে এলো ঈদ। কিন্তু ঈদ এলেও হাওরবেষ্টিত ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের বানভাসিদের মধ্যে নেই ঈদের আনন্দ। এখনো হতদরিদ্ররা ছুটছেন ত্রাণের জন্য। অনেকের ঘরে ছেলেমেয়েদের কাপড়চোপড়ও নেই। কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন হাওরাঞ্চলের মানুষজন। সুনামগঞ্জ জেলা জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি সেলিম আহমেদ বলেন, হাওরের জেলা সুনামগঞ্জবাসী এর আগে কখনো এত বড় দুর্যোগ দেখেননি। একের পর এক দুর্যোগে হাওরবাসী আজ দিশাহারা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

ছায়াদ মিয়া, শান্তিগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) : হাওর পাড়ের মানুষের জন্য এবারের ঈদ ভয়াবহতার। ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় তছনছ হয়ে গেছে হাওরাঞ্চলের শান্তিগঞ্জের মানুষের জীবন। বন্যা সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে মানুষের। বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও অনেক এলাকা এখনো তলিয়ে আছে। এর ফলে বানভাসিদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। কিছু মানুষ বাড়ি ফিরলেও অনেকেই এখনো ঘরের বিভিন্ন আসবাব উঁচু জায়গাতেই তুলে রেখেছেন। সব মিলিয়ে ভয়াল বন্যার চরম দুর্ভোগের মধ্যেই তাদের সামনে ঈদে এসেছে। তাই হাওরবাসীর কাছে এবারের ঈদ বেদনা আর হতাশার।

সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখনো রাস্তায় আছেন শত শত মানুষ। ছেলেমেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। পানি কমলেও এখনো আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়েননি বানভাসি মানুষ। ঈদে বাড়ি না ফিরতে পারায় তাদের চোখেমুখে কান্নার ছাপ। বন্যা ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। বানভাসি মানুষ এখন ঈদের আনন্দে নেই, ঘরে ফেরাই এখন তাদের কাছে বড় স্বপ্ন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ার উজ জামান বলেন, শান্তিগঞ্জে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ঘর মেরামতের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমরা যেখানে যা প্রয়োজন সব করছি।

শংকর দত্ত, ছাতক (সুনামগঞ্জ) : সুনামগঞ্জের ছাতকে নদনদীর পানি কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ঈদ আনন্দের কোনো উচ্ছ্বাস নেই। ঘরবাড়ি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় হতদরিদ্র মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাই দুদিন পর ঈদ হলেও সেই আনন্দ নেই মানুষের মনে।

শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যা ভাসিয়ে নিয়েছে ঘর। নষ্ট হয়েছে ঘরে থাকা ধান-চাল ও জামাকাপড়। শুধুমাত্র নিজের জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু জায়গায়। ঘরের আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিস, কিছুই বাঁচাতে পারেননি বানভাসি মানুষ।

ইসলামপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের আনোয়ার আহমদ বলেন, বন্যা আমার সব তছনছ করে দিছে। আমার ১১টা ভেড়া মারা গেছে। স্বপ্ন ছিল আগামী ঈদের বাজারে বিক্রি করে টাকা দিয়ে ঘর মেরামত করব। বাচ্চাদের পোশাক দেব। কোনোটাই পূরণ হলো না। এবার গরিবের ঘরে ঈদ নেই। এমন দুর্ভোগের কথা জানান মসজিদের মুয়াজ্জিন আনোয়ার আহমেদ।

ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানান, এবারের ঈদ অন্য বছরের তুলনায় খুব বেদনাদায়ক। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সাধ্য মতো মানুষের দুয়ারে ত্রাণ নিয়ে কখনো বা নগদ অর্থ নিয়ে গেছি। দেখেছি বন্যায় বানভাসি মানুষ সুখে নেই। আর বরাদ্দ পরবর্তী সময়ে এলে সঠিকভাবে বণ্টন করা হবে। যোগ্যরাই পাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App