×

জাতীয়

হাওরাঞ্চলে নেই ঈদের আবহ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২২, ০৮:৩৯ এএম

হাওরাঞ্চলে নেই ঈদের আবহ

ফাইল ছবি

বন্যায় নিঃস্ব মানুষের সামনে বাঁচার লড়াই , শত শত পরিবার এখনো ঘরে ফিরতে পারেনি

সিলেট-সুনামগঞ্জের ভয়ংকর বন্যায় মানুষের সব স্বপ্ন ভেসে গেছে। সাজানো ঘরবাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, কাঁথা-বালিশ, কাপড়চোপড়, গবাদিপশু, সারা বছরের খাওয়ার জন্য রাখা গোলা ভরা ধান- পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সব হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। বিভিন্ন জায়গায় এখনো পানির নিচে ডুবে আছে সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ফলে আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে আগামী আগস্টে এবং এইচএসসি পরীক্ষা অক্টোবরে নেয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। সরজমিন দেখা গেছে, কয়েকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কিছুটা কমলেও আক্রান্ত মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা এখনো বহুদূর। ঘর হারিয়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সড়কে। গোলার ধান পানিতে ডুবে চারা হয়ে গেছে। দিশাহারা মানুষগুলো এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে জীবনযুদ্ধের পুঁজি। এরকম পরিস্থিতিতে কদিন পরই দেশে উদযাপিত হবে ঈদুল আজহা। কিন্তু সর্বনাশা এই বন্যার কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় এবার ঈদের আবহটাই নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ সবকিছু হারিয়ে এখন বাঁচার জন্য লড়াই করছে।

গত ১২ দিনে বন্যাক্রান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চরম সংকটে জর্জরিত সেখানকার মানুষ। দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে সহসাই রেহাই পাওয়ার আশাও নেই। বেশির ভাগ বাজার এখনো পানির নিচে। তবু কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে উঁচু রাস্তায় বাজার বসেছে। যেসব জায়গায় বাজার বসেছে সেসব জায়গায় লাগামহীনভাবে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ নানা জিনিসপত্রের দাম। এতে চরম ভোগান্তিতে দিন পার করছেন বন্যাক্রান্ত এলাকার নাগরিকরা। এমনকি হিমশিম খাচ্ছেন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে গবাদি পশু বেচাকেনায়ও। বন্যার কারণে পশু না থাকা এবং কোথাও কোথাও থাকলেও গত বছরের তুলনায় এ বছরের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় পচ্ছন্দের পশুটি কিনতে পারছেন না অনেকেই। অনেকেই আবার সকাল থেকে ঘুরে একটা পশুও কিনতে পারছেন না। এতে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ক্রেতাদের মধ্যে। আবার উল্টোদিকে, হাওর জনপদে গরু-ছাগলের বাজার প্রস্তুত হলেও ক্রেতাশূন্য থাকছে। বন্যার কারণে সব হারিয়ে বাধ্য হয়ে গ্রামীণ এলাকার বহু মানুষ কুরবানি দেয়া থেকে বিরত থাকছেন বলে জানা গেছে। তবে সিলেট মহানগরে বহু দোকানে বিকিকিনি হতে দেখা গেছে। পশুর হাটও বসেছে। সেখানেও ক্রেতার অভাব রয়েছে।

সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদের শাখা জাহাজখালি নদী। এর পাড় ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিম বুড়োদেও গ্রাম। এ গ্রামেই থাকেন আখতারুজ্জামান-মুর্শিদা খাতুন দম্পতি। বন্যার পানি তাদের ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। দিন কয়েক আগে ঘরে ফিরে দেখেন, তাদের পুরো ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভেসে গেছে ফ্রিজ, আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, চাল-ডাল। সব হারিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন তারা। মুর্শিদা খাতুন বলেন, শাশুড়ি, স্বামী এবং দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। বন্যায় সন্তানদের বইপুস্তকও ভেসে গেছে। ঘরে খাবারদাবারও নেই। ভাঙা ঘর মেরামত করার সামর্থ্যও নেই। উপজেলা সদরের পাশে গ্রামের অবস্থান হওয়ায় সচ্ছল ভেবে কেউ ত্রাণও দেয়নি। অথচ এখন না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা আমাদের। এই অবস্থায় কুরবানির ঈদ আমাদের জন্য আনন্দের নয়, হাহাকারের।

ভোরের কাগজের ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি শংকর দত্ত জানিয়েছেন, বন্যা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বাসিন্দাদের। ঈদুল আজহার আর হাতে গোনা কয়েকদিন বাকি। কিন্তু এখনো কুরবানির পশুর হাট বসা, বিপণিবিতানের প্রস্তুতিসহ অন্যান্য কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। বন্যার কারণে কোথাও ঈদুল আজহা নিয়ে নেই কোনো আগ্রহ। ভয়াবহ বন্যার কারণে উপজেলাজুড়ে থমকে আছে কুরবানির ঈদের প্রস্তুতি।

জানা গেছে, প্রতি বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে কমপক্ষে ১৫ দিন আগে থেকেই উপজেলাজুড়ে শুরু হয়ে যেত কুরবানির প্রস্তুতি। গত দুই বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে সীমিত পরিসরে কুরবানির পশুর হাট বসানো হয়। তবে শেষ সময়েও পশু বেচাকেনা নিয়ে হুড়োহুড়িতে পড়তে হয় তাদের। তবে বন্যার কারণে ছাতকের এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবার গোবিন্দগঞ্জ ও জাউয়া বাজারসহ ৮টি স্থায়ী বাজার ছাড়াও ৮ ইউনিয়নের ৮টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। খামারি ও কৃষকরা বলেছেন, বহু এলাকা এখনো পানিতে নিচে ডুবে রয়েছে। ফলে গবাদিপশু নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন তারা। অনেক এলাকায় কচুরিপানা খাইয়ে গবাদিপশুকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন ঈদুল আজহায় ছাতকের থাকা ১০টি পশুর হাট জমে উঠবে কিনা, এ নিয়ে শঙ্কিত ক্রেতা-বিক্রেতা। গরু ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা জানিয়েছেন, উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ, বাংলাবাজার, জাউয়া বাজার ও ছৈলা-আফজালাবাদ ইউনিয়নে বেশির ভাগ গরু লালন-পালন করা হয়। এখানকার গবাদিপশুর খাদ্যের প্রধান উৎস খোলা মাঠের ঘাস। কিন্তু চলতি বছরে তিন দফা বন্যায় তলিয়ে রয়েছে মাঠঘাট। ফলে গবাদিপশুর খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করেছে। তারা এখন নিজেদের গরু বাঁচানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এদিকে বন্যার কারণে বেচাকেনা কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বিভিন্ন বিপণিবিতানের মালিকদের। এ কারণে দোকানে পণ্য তুলছেন না অনেকেই। আগে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এমন সময়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কাপড়, জুতা, কসমেটিকস, মুদিপণ্যসহ নানা ধরনের সামগ্রী কিনতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তেন। এবার ব্যবসায়ীরা সে ঝুঁকি নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।

গোবিন্দগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য আব্দুস শহীদ জানান, এই সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসতেন। কিন্তু বন্যার পানির কারণে তাদের আসা-যাওয়া না থাকায় ঈদের রেশ নেই। পোশাক ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ঈদুল আজহায় নতুন পোশাক আনার জন্য আমাদের লোক ঢাকায় বসে থাকত। এবার কাউকে পাঠাইনি। ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ ডাচ বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আফাজ উদ্দীন বলেন, প্রবাস থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা এখনো অনেক কম। অন্যান্য বছর এমন সময়ে রেমিট্যান্স নিতে ব্যাংকগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থাকলেও এবার কোনো ব্যাংকেই তা দেখা যায়নি। গোবিন্দগঞ্জ বাজার ব্যাবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আশরাফুর রহমান চৌধুরী জানান, আশা করছি বন্যায় বিপর্যস্ত এই অঞ্চলের মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে।

হাওরাঞ্চলে নেই ঈদের আনন্দ : ভোরের কাগজের দিরাই (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জয়ন্ত কুমার সরকার জানিয়েছেন, হাতে গোনা কদিন বাদেই ঈদুল আজহা। কিন্তু বন্যাদুর্গত এলাকায় নেই ঈদের আমেজ। তারা বলেছেন, এখন শুধু বেঁচে থাকাই যেন সংগ্রাম। বন্যার আশ্রয়হীন হয়ে পড়া অধিকাংশ লোকজন নিজগৃহে ফিরতে পারেনি। পানি কমতে থাকায় ধীরে ধীরে ভয়াবহ বন্যার ক্ষত চিহ্নগুলো বেরিয়ে আসছে। বানের পানি হাওরের অধিকাংশ কাঁচা ঘরের বেড়া ধসিয়ে দিয়েছে। হাওরের উত্তাল ঢেউ বসত বাড়ির আঙ্গিনা এমনকি ঘরের মেঝে থেকেও মাটি নিয়ে গেছে। হেলে পড়েছে নতুন পাড়াতে গড়ে উঠা বসতবাড়ি। নষ্ট হয়ে গেছে ঘরে রাখা মূল্যবান আসবাবপত্র, দলিল দস্তাবেজ, শিক্ষার্থীদের খাতা-বই। টিনের ঘর এমনকি আধাপাকা ঘরেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সব গ্রাম থেকে পানি না নামায় বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। বসতবাড়ি থেকে পুরোপুরি পানি না নামায় বেশির ভাগ বন্যার্তই ফিরতে পারছেন না নিজগৃহে। কেউ বা আশ্রয় কেন্দ্রে কেউবা পার্শ্ববর্তী উঁচু বাড়িতে অবস্থান করছেন। স্থানীয় বাজারগুলোতে পানি উঠে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমন ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বন্যাদুর্গত হাওরবাসীর মনে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব যেন নামমাত্র এখন।

তাড়ল ইউনিয়নের নওয়াগাঁও গ্রামের রমজান আলী হতাশকণ্ঠে বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরে যাইতে পারি নাই, ঈদের কথা ভুলেই গেছি।’ রমজানের কথার মধ্যেই যেন পুরো হাওরবাসীর মনের কথা ফুটে উঠেছে। দিরাই পৌর শহরের ভরারগাঁও গ্রামের সিজিল মিয়া বলেন, আমার দুইটা মেয়ে নিয়ে হাঁটু সমান পানির মধ্যেই ঘরের মধ্যেই এখনো বসবাস করছি। ঈদের ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই, তার মুখে অন্ধকার নেমে আসে। চরনারচর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামের আব্দুল মজিদ বলেন, শেরপুর গ্রামের ৬০ ঘরে ৪০০ জনসংখ্যা। এখনো পর্যন্ত গ্রাম থেকে পানি নামেনি। পুরো গ্রামবাসী ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত। গতকাল রবিবার দুুপুরে দিরাইয়ের অন্যতম বড় গরুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাতেগোনা ১০-১৫টি গরু বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। কোনো ক্রেতাকে গরুর হাটে দেখা যায়নি। হাটের অন্যতম ইজারাদার রায়হান মিয়া বলেন, বন্যার কারণে এ বছর বেচাকেনা কম হবে। অন্তত শতকরা ৪০ ভাগ গরু-ছাগল কম বিক্রির আশঙ্কা করছেন তারা। রায়হান মিয়া বলেন, বন্যার কারণে কারো ঘরেই গরুর যথেষ্ট পরিমাণ খাবার নেই। চারদিকে পানি থাকার কারণে গরুর বাসস্থানের একটি সমস্যা আছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, শেষ দুইদিন কিছু বেচাকেনা হলেও হতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App