×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও আমাদের বিপত্তি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২২, ০১:০৭ এএম

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্যের জের ধরে নড়াইলের মির্জাপুর কলেজের অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রকাশ্য জনসমাগমের মধ্য দিয়ে পুলিশ হেফাজতে নেয়া, ঢাকার সাভারে স্টাম্পের আঘাতে শিক্ষককে হত্যা করা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের ভেতর শিক্ষককে হেনস্তা করা ইত্যাদি নানা ঘটনা এখন স্ব-স্ব অঞ্চল পেরিয়ে সমগ্র দেশেরই সামাজিক সংকট হিসেবে মূর্তমান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের ‘গরম খবর’ হওয়ায় এর বিস্তৃত প্রভাবের ফলে সমগ্র দেশেই ‘শিক্ষক’ প্রত্যয়টি এখন আলোচনার এক বিশেষ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আলোচনা, সমালোচনা হবে- হোক। কিন্তু এসব ঘটনা সামনে রেখে আমাদের তো সমাজ, সামাজিকতা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি বিষয়েও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। এটাও চিন্তা করতে হবে যে, সামগ্রিকভাবে সমাজকে এরূপ প্রবণতার দিকে কোনো ক্রমেই ঠেলে দেয়া যাবে না। সমাজ যেন অধঃপতনের দিকে ধাবিত না হয় সেজন্য গভীর দরদ ও মর্মসহ চিন্তা করতে হবে। সুস্থ চিন্তার মধ্য দিয়ে সংকটের এই ঘোর আবর্ত থেকে সামগ্রিকভাবে মুক্তির যথাযথ উপায়ও খুঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে দেরি করাটাই হবে অন্তর্ঘাতমূলক। কেননা এসব চর্চার মধ্য দিয়ে একটি বিকারগ্রস্ত প্রজন্মই তৈরি হবে মাত্র! যারা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবেই হিতকরি নয়। ‘শিক্ষা-সংস্কার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একদা বলেছিলেন : ‘দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি, তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব- অন্নে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, বুদ্ধিতে মরিব, চরিত্রে মরিব- ইহা নিশ্চয়। বস্তুত আমরা প্রত্যহই মরিতেছি অথচ তাহার প্রতিকারের উপযুক্ত চেষ্টামাত্র করিতেছি না, তাহার চিন্তামাত্র যথার্থরূপে আমাদের মনেও উদয় হইতেছে না, এই-যে নিবিড় মোহাবৃত নিরুদ্যম ও চরিত্রবিকার- বাল্যকাল হইতে প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত কোনো অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ইহা নিবারণের কোনো উপায় নাই।’ শিশুদের প্রতি আমাদের অবহেলা, অযতœ আর উদাসীনতাই বেশি কাজ করে। পারিবারিক আবহের মধ্যে শিশুর যে মনন ও মানস গড়ে ওঠে পরিণত বয়সে তারই প্রতিফলন সমাজে প্রকাশিত হয়। চরিত্র গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা থাকলেও পরিবারই শিশুর প্রধান শিক্ষালয়। কিন্তু এ কথা আমরা মনেই রাখি না কিংবা ক্বচিৎ মনে রাখলেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখি না। মনে রাখি না বলেই শিশুদের প্রতি পরিবারের প্রাথমিক দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা আমাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। শিশুর মানস গঠনের দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত থাকার অভ্যাস আমাদের চরিত্রে বদ্ধমূল। শিশুদের মানস গঠনে পরিবারের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলার ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মানুষের মতো মানুষরূপে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পরিবারের সামগ্রিক আবহ থেকে উন্মূল হয়ে বিচ্ছিন্ন এক জগতের তথাকথিত মানুষরূপেই বড় হয়ে উঠছে তারা। এ ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ সর্বোপরি একজন সফল সামাজিক মানুষ হিসেবে কোথাও স্থানও করে নিতে পারে না। সমাজের মধ্যে থেকেও অসামাজিক এক গলগ্রহ হিসেবে ভাসমান জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়। শিশুদের নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে এবং শিশুদের পরিবারের সব সদস্যের পক্ষ থেকে যথার্থ সময় দিতে হবে যাকে বলে ‘কোয়ালিটি টাইম’। কেননা বিপন্ন শৈশব থেকেই বিপর্যস্ত তারুণ্য- যা কেবল উচ্ছৃঙ্খলতার জন্ম দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভারাক্রান্ত করে চলে। কিছু দিন আগে আমরা ঢাকার তেজগাঁও কলেজ শিক্ষিকার টিপকাণ্ড, নওগাঁয় স্কুলে ছাত্রীদের হিজাব খুলে ফেলার ঘটনা, মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের জেল খাটার ঘটনা দেখেছি। দেখেছি সামাজিক নানা ধরনের প্রতিবাদও। তবু ভিন্ন আঙ্গিকে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। কোনো কিছু থেকে আমরা কোনো শিক্ষাই যেন গ্রহণ করতে পারি না। তাই নড়াইলে কলেজের অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানোর ঘটনা ঘটে কিংবা সাভারে শিক্ষার্থীর স্টাম্পের আঘাতে শিক্ষককে মৃত্যুবরণ করতে হয়! এসব ঘটনা লৌকিক কিংবা অলৌকিক যেভাবেই ঘটুক না কেন প্রতিটি ঘটনার শিকার শিক্ষক। আবার ঘটনার নিকটবর্তী হলে, কাছাকাছি গেলে, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এসব অমানবিক, অসামাজিক এবং অসমর্থনযোগ্য ঘটনাগুলোর প্রতিটিরই শিকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষক। এ রকম একেকটি কাণ্ড বাংলাদেশের একেক প্রান্তে একেক সময়ে ঘটলেও সেসব যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা তা আমরা মনে করতে পারি না, খুব সহজে মেনেও নিতে পারি না। দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে আমরা যদি সরলীকরণ করে ফেলি তাহলে এসব অন্যায় অপরাধের প্রবণতা আরো বিস্তৃত হবে এবং এর সুষ্ঠু বিচার পাওয়াও সম্ভব হবে না কোনোদিন। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি ন্যক্কারজনক এসব ঘটনার বিচার আদৌ চাই কি না? অন্যান্য বহুবিধ পেশার মানুষের চেয়ে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার প্রকৃতি ও স্বরূপ একেবারেই যেন ভিন্ন। বাহ্যিক চাকচিক্য, জাঁকজমক এবং জৌলুসের বিপরীতে তা অদৃশ্য বটে কিন্তু অসীম। বাহ্যিক চাকচিক্য, জাঁকজমক ও জৌলুস নেই- কিন্তু অন্তর্গত অনুভবে শিক্ষকরা এসব লাভের ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়েই শিক্ষক হন। দারিদ্র্যকে বরণের মধ্য দিয়ে মহত্ত্বকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তোলেন। অর্থাৎ এসব আড়ম্বরপূর্ণ সহস্র চাহিদাকে জয় করে মানবিক ঐশ্বর্যেই সমাজে শিক্ষকরা বসবাস করেন- শিক্ষার্থীদের কর্মময় জীবনের আদর্শ, রুচি, সংস্কার-সংস্কৃতি এমনকি জীবনযাপনের অন্তর্গত অনুভব হয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মনের মধ্যে বিরাজ করেন। ‘বিরাজ’ শব্দটির ওপর আমরা বিশেষ জোর দিতে চাই- শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অদৃশ্য গুণাবলির অস্তিত্ব সদাসর্বদাই অনুভব করে। যেসব শিক্ষকের কাছে আমাদের হাতেখড়ি, যাদের সৃষ্টিগুণ ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকবর্তিকার মাধ্যমে আমরা মানুষ, সমাজ, ধর্মকর্ম, জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনের বোধ অর্জন করি সেসব শিক্ষকই আমাদের অন্তর্জগতে ব্যাপক অস্তিত্ব নিয়ে সদাই বিরাজমান। শৈশবের শিক্ষকরা তাই এখনো বর্তমান, শারীরিকভাবে মৃতরাও আমাদের কাছে আদর্শিকভাবে জীবন্ত ও উজ্জ্বল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার এই সম্পর্কের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার কোনো বাছবিচার নেই, নেই অবৈজ্ঞানিক চিন্তাপ্রসূত কোনো বিকারও। কেননা, তাদের জ্ঞান, দর্শন ও আদর্শের সূ² আলোক-রশ্মি এখনো আমাদের জীবন চলার পথের পাথেয়। আমরা জীবন যুদ্ধের প্রাত্যহিক সংগ্রামে ব্যস্ত থাকলেও কোনো না কোনো সময় কোনো না কোনো শিক্ষকের অদৃশ্য মূর্তির সামনে দাঁড়াই- মুখোমুখি হই। শিক্ষকেরই জ্ঞানের দ্যূতি, দর্শনের আলো, বিজ্ঞানের যৌক্তিকতা জীবনযুদ্ধের সংগ্রামে আমাদের নিয়তই ভরসা যুগিয়ে চলে, পথ দেখিয়ে নেয়। আমরাও আশ্বস্ত হয়ে সংগ্রামশীল জীবনটাকে উদযাপন করি। নানা বর্ণের বর্ণিল উদযাপনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। প্রাচীনকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি সমাজে শিক্ষকরা আদর্শিক এক উচ্চতা নিয়ে অনন্য অবস্থানে বসবাস করেন। সেখানে বিত্তের বৈভব হয়তো নেই- অন্তরের অনাবিল ঐশ্বর্য আছে যা যুগযুগান্তরকে আলোকিত করে আসছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। আমরা মহামতি আলেকজান্ডারের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা সবাই জানি। তিনি শিক্ষকের মর্যাদাকে সম্মানিত করেছিলেন এই বলে যে, ‘আমি আমার জীবনের জন্য পিতার নিকট ঋণী আর জীবনকে কীভাবে যাপন করতে হয় সেই শিক্ষার জন্য এরিস্টটলের নিকট ঋণী।’ বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদাকে সর্বোচ্চে নির্দেশ করেছিলেন। কবি কাদের নেওয়াজের লেখা ‘ওস্তাদের কদর’ কবিতাটির কথাও আমরা অনেকে জানি। সেখানে বাদশা আলমগীর দেখেছিলেন রাজপুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছেন আর শিক্ষক নিজ হাতে নিজের পা প্রক্ষালন করছেন। এজন্য বাদশা আলমগীর শিক্ষককে নিরালায় ডেকে আনেন। কবিতায় তারপরের অংশ এরূপ : ‘সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে/ নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন/ পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ/ নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে/ ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে’/ উচ্ছ¡াস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে/ কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-/ ‘আজি হতে চির-উন্নত হল শিক্ষা গুরুর শির/ সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’ সাম্প্রতিককালে আমরা নানাভাবে শিক্ষকদের ওপর আঘাত আসতে দেখছি, আঘাত আসছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপরও। একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি তির্যকভাবে শ্লেষের সঙ্গে বলেছিলেন ‘মারতে মারতে সংখ্যালঘু যখন শেষ হয়ে যাবে তখন কিন্তু আঘাতগুলো সংখ্যাগুরুর ওপরই আসবে। কারণ মারণে-অলারা তাদেরকে টার্গেট করেছে যারা প্রগতির কথা বলে, বিজ্ঞানের কথা বলে, ন্যায়ের কথা বলে। সংখ্যালঘু দিয়ে শুরু, শেষটা হবে কিন্তু সংখ্যাগুরু দিয়েই।’ তাৎক্ষণিক আলাপচারিতায় এরূপ লঘু বক্তব্য একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবলে এ কথার গভীর সারবত্তা অনুভব করা যায় বৈকি। তাহলে কি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ও আদর্শের ওপর ক্রমাগত আঘাতই আসতে থাকবে? ভাবতে হবে এই আঘাত কীভাবে প্রতিহত করা সম্ভব? আমরা কীভাবে এ আঘাত প্রতিরোধ করব? শিক্ষকরা কি শিক্ষার্থীর প্রতিপক্ষ অবস্থানে দাঁড়াবেন? কোনো শিক্ষক কখনোই তা পারবেন না। শিক্ষার্থীর কল্যাণের জন্যই শিক্ষক কখনো বা কঠোরতা দেখান, কঠোর হন, এক ধরনের চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীর ভেতরকার অকল্যাণ বিনাশের মাধ্যমে কল্যাণ ও মঙ্গলের আবাহন করেন। শিক্ষার্থী যখন সেই আহ্বান-আবাহনকে উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয় তখনই সৃষ্টি হয় বিপত্তির। সাভারের শিক্ষক-হত্যার ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করে, আমরা বিস্মিত হই! ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কথা বাদ দিলেও বলা যায় এ তো মনুষ্য সমাজের কাজ নয়। এরূপ বিপত্তির উৎস তাহলে কোথায়? আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App