×

মুক্তচিন্তা

বর্তমানের ধর্মীয় মৌলবাদ দীর্ঘদিনের মতলবী রাজনীতির বিষবৃক্ষ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২২, ০১:০৭ এএম

ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ আসছে। তার আগেই ভারতে বা বাংলাদেশে ধর্মবিদ্বেষের বিষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ঘটনার সূত্রপাত ভারতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে এক টিভি বিতর্কে করা বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মার মন্তব্য থেকে সে দেশের আপামর মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। কয়েক হাজার মামলা তার বিরুদ্ধে করা হয়েছে। নূপুর শর্মা তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলেও শাসক দল বিজেপি নূপুর শর্মাকে বহিষ্কার করেছে। একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে, নূপুর শর্মা যে মন্তব্য করেছেন তা চূড়ান্ত নিন্দার্হ এবং ভারতীয় পরম্পরাবিরোধী। ভারতে ২৩ কোটি মুসলমান বাস করেন এবং তাদের নিয়েই দেশ। এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ আদালত নেবেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা উচিত। কিন্তু এই বিষয়ে হিন্দুত্ববাদীরা অতি উৎসাহে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সোশ্যাল মিডিয়াতে অবিবেচকের মতো পোস্ট দিচ্ছেন এবং তাতে তিক্ততা বাড়ছে। তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় গত ১৭ জুন রাতে ফেসবুকে নূপুরকে প্রশংসা করে যে পোস্ট দেন সে পোস্টটি তার বন্ধুরা মুছে ফেলতে বললেও সে তা করেনি। কাজেই বিষয়টি নিয়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কাছে নালিশ জানায় কয়েক মুসলিম ছাত্র। একই সঙ্গে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সেই অপরাধে অধ্যক্ষের মোটরসাইকেলসহ শিক্ষকদের ৩টি সাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। পুলিশ অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। এর মধ্যেই স্থানীয়রা তাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দেয়। শিক্ষককে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে দেয়ার দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ইতোমধ্যে নূপুর শর্মার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু মুসলমানপ্রধান অঞ্চলে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন লাগানো হয় এবং দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে গত ২৫ জুন আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল এন্ড কলেজের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে (৩৭) স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু, যার বাবা এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। অতি দ্রুত জিতুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৮ জুন ভারতের রাজস্থানে উদয়পুরে জনাকীর্ণ বাজারের ভেতর মুহম্মদ রিয়াজ আখতার ও মুহম্মদ গোশ নামের দুই যুবক দরজি কানহাইয়া লালকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সেই দরজির অপরাধ এই যে, তার ছেলে সোশ্যাল মিডিয়াতে নূপুর শর্মার বক্তব্যের সমর্থনে পোস্ট দিয়েছিল। গোটা ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করে হত্যাকারীরা। এরপর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়। কোনো ধর্মই মানবতার বিরুদ্ধে সহিংসতা সমর্থন করে না। বাংলাদেশে ঢাকায় অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোর বিরুদ্ধে ও সাভারে শিক্ষক হত্যার অপরাধীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রতিবাদসভা ও মানববন্ধন হয়েছিল। আজ বাস্তব এই যে ভারতে ও বাংলাদেশে সরকার ও প্রশাসনের অতি দ্রুত পদক্ষেপ সত্ত্বেও ক্রমে ক্রমে ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর পেছনে দীর্ঘদিনের রাজনীতি ভীষণভাবে দায়ী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলা ভাষাভাষীদের ঐকতানের মূল জায়গাটিই হচ্ছে তার হাজার বছরের গৌরবমাখা ইতিহাস ও সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির এক বিশাল অংশজুড়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তার লাভ করা ‘সুফিবাদ’, যা মানুষকে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ‘সুফিবাদ’ অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ ও সর্বজনীন ভালোবাসা ও প্রেমদর্শনের যৌগিক এক জীবনদর্শন। সে অর্থে সুফিবাদ হচ্ছে আরবি ইসলামের কট্টর-মৌলবাদের বিপরীতে অবস্থান নেয়া অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন প্রেমদর্শন-মিশ্রিত এক আদর্শজীবন, যা ইসলামের উদারনীতি ও মানবতাবাদী আদর্শকে উজ্জীবিত করে মানবকল্যাণের দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভেঙে সেকুলার এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু ১৯৭৫ সাল থেকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে ধ্বংস করে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ‘পাকিস্তানি বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার অশুভ চেষ্টা থেকে মৌলবাদী শক্তি কখনই বিরত থাকেনি। মুজিব হত্যার মূল চক্রী খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ- এই তিন শাসক মিলে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানিকরণ করেছেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করার পর আইএসআইর উদ্যোগে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও গোলা বারুদ আনা হয় অবৈধ পথে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এই সময়ই ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে চট্টগ্রামের একটি কারখানার জেটিতে। আবার এই কট্টর মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হওয়ার পরে তারা নিঃসারে ঢুকে পড়ছেন শাসক দলের ছত্রছায়ায়, অবশ্যই অন্য নামে। আজকের বাংলাদেশে আমরা যে জঙ্গিবাদ দেখছি তা হলো বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িকতার পথ থেকে সরিয়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রের পরিণতি। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে ভারতে। বর্তমান ধরনের অনুদার সঙ্কীর্ণচেতা ‘গণতন্ত্র’-এর অভ্যুত্থান আসলে পাকা হয়ে গিয়েছিল সেই ১৯৯২ সালে, যখন অযোধ্যায় সম্রাট বাবরের আমলে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হলো লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলি মনোহর জোশী, উমা ভারতী প্রমুখ বিজেপি নেতার উপস্থিতিতে; অভিযোগ সংঘের পরিকল্পনাক্রমেও বটে। এই ধ্বংসযজ্ঞে শুধু যে মসজিদটিই চুরমার হলো তা নয়, প্রথম বড় ধাক্কা এলো এই প্রতিষ্ঠিত ধারণায় যে, ভারতে সর্বধর্মের মর্যাদা সমান। ঘটনার সময়ে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির সরকার। বিজেপি তো যা চাইছিল- হিন্দু-মুসলমান বিভাজন রেখাটি তীক্ষè করা- তা-ই ঘটল। বাবরি ধ্বংসের পর ঘটল ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসেই মুম্বাই দাঙ্গা ও ১৯৯৩ সালের মার্চে মুম্বাই বোমা বিস্ফোরণ। এই সময় থেকেই বিজেপির এক বিশ্বস্ত সমর্থকের দল তৈরি হলো, যারা ‘ধর্মের রক্ষক’ বলে দলটির পূজা শুরু করল। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সবচেয়ে কৌশলী নেতা মোদির উত্থান রুখবার আর কোনো রাস্তা খোলা রইল না। ক্রমে মানুষ হিন্দুত্বের কথায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ল, যার প্রতিচ্ছবি আজকের সমাজ। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল মুসলিম সমর্থনের মুখাপেক্ষী হওয়ায় মুসলমানদের কোনো দোষ দেখে না। মেরুকরণের প্রচার চলছে তীব্র ভাষায়। সুশীল সমাজও আজ প্রসাদের লোভে পুচ্ছ নাচাচ্ছেন দলীয় সমর্থনে। ফলে বিদ্বেষ বাড়ছে ক্রমাগত। আজ দুদেশের রাজনৈতিক নেতারা সময়ে অসময়ে ব্যবহার করেন এই ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দের তাসটি। এমনকি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা কারোর ওপরে রুষ্ট হলেই দেগে দেন এই শব্দটি। শব্দটি ব্যবহারকারীরা নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলে ঢক্কানিনাদ করেন অথচ নিজ স্বার্থে তারাই লড়িয়ে দেন দুই সম্প্রদায়কে। যে কোনো সংঘাত বা দাঙ্গার পেছনে খেয়াল করুন যারা লড়েছেন পরস্পরের বিরুদ্ধে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ কখনই ছিল না। কিন্তু লড়িয়ে দেয়া মানুষদের স্বার্থ ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি এবং সে স্বার্থ রাজনৈতিক। দাঙ্গা কোনোদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করার জন্য লাগে পরিকল্পনা, প্রচার ও পরিকাঠামো, আর এই দুইয়ের মধ্যে নিখুঁত সমন্বয় সাধন করার মাধ্যমেই দাঙ্গার মাধ্যমে রাজনৈতিক লাভ কুড়ানো সম্ভব হয়। কাজেই উপায় কী? এখন উপায় একটাই তা হলো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের সোচ্চার হওয়া। বাংলাদেশে এই সচেতনতা আছে বলেই এখনো প্রতিবাদসভা হচ্ছে, মানববন্ধন হচ্ছে। কিন্তু ভারতে? সংবিধান নির্দেশের কঠোরতায় কিছু গ্রেপ্তার হলেও ধর্মবিদ্বেষের বিষের মূলোৎপাটনে কোনো উদ্যোগ সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে না। কিছু জেগে থাকা মানুষের স্মৃতিতে ঘাই মারছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার অমোঘ লাইন- শুয়োরের বাচ্চারাই সভ্যতার নামে জিতে গেল/ ওদের নিজস্ব রাস্তা, ওরাই দৌড়োবে/ ওদেরই মুখোশ নিয়ে দেশে দেশে চলে যায় অবিমিশ্র দূত/ বিমানের সিঁড়ি থেকে পা পিছলে কোনোদিন/ একজনও পড়ে না।/ বাঁধানো দাঁতের হাস্যে সভ্যতার নাম রটে খুব। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App