×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২২, ১২:২৮ এএম

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা

রিকশা চালানো বাংলাদেশের সবচেয়ে কষ্টসাধ্য এবং স্বল্প পারিশ্রমিকের একটি কাজ। ২০০৩ সালে চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সে সময় ঢাকা শহরের একজন রিকশাচালকের গড় মাসিক আয় ছিল মাত্র ৮৫ মার্কিন ডলার। এই সময়টায় হাসেম আলী নামে একজন রিকশাচালক ঢাকায় থাকতেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অগণিত ভক্ত-অনুসারির মতো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনা রিকশাচালক হাসেম আলীকে ভীষণভাবে যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু অসহায় রিকশাচালকের নেতা হারানোর যন্ত্রণা বুকের মাঝে নিয়ে বেড়ানো ছাড়া খুব বেশি কিছু করার ছিল না। সত্যিকারের নেতাকর্মীর সম্পর্ক অনেক সময় রক্তের সম্পর্কের থেকেও গভীর হয়ে যায়। তার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর এতিম সন্তান শেখ হাসিনার জন্য নিজ খরচে একটি জায়গা কেনার পরিকল্পনা করেন। দীর্ঘদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আর অভাবের সংসার থেকে টাকা জমিয়ে ২০০৩ সালে হাসেম তার নিজ জেলা ময়মনসিংহে শেখ হাসিনার নামে এক টুকরো জমি রেজিস্ট্রি করেন। এর অল্প সময় পর হাসেম আলী য²া রোগে মারা যান। অনেকটা বিনা চিকিৎসায়। অনেকে পরামর্শ দিয়েছিল, শেখ হাসিনার নামে কেনা জমিটা বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। হাসেম আলীর হয়তো কখনো বঙ্গবন্ধুকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। অথবা হলেও কাছে থেকে কথা বলা হয়নি। কিন্তু দিনমজুর সাধারণ মানুষের প্রতি শেখ মুজিবের অন্তহীন ভালোবাসা আর দেশের প্রতি আত্মত্যাগ হাসেম আলীকে দূর থেকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, তিনি তার নিজের জীবনের থেকে মুজিবকে বেশি ভালোবেসে ছিলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুও সেই ভালোবাসায় দাগ ফেলতে পারেনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বলতে আমরা মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যা শেখ হাসিনাকেই বুঝি। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দল হিসেবে ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার বাইরে থেকে আওয়ামী লীগ যা কিছু অর্জন করেছে তার সবটুকুই হয়েছে এই দুজনের নেতৃত্বে। এই দুই নেতার প্রতি সাধারণ মানুষ এবং দলের কর্মীদের ভালোবাসার অসংখ্য উদাহরণের একটি ‘হাসেম আলীর’ ঘটনা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুই আওয়ামী লীগ নেতা কীভাবে সাধারণ মানুষকে এত বেশি প্রভাবিত করলেন। সেই উত্তর খুঁজতে গেলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস কিছুটা হলেও জানতে হবে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব শুধু উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান ঘটায়নি। এর প্রভাব দেশে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সরাসরি শাসন কায়েম করে এবং ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ সম্রাজ্য ধরে রাখার জটিল সমীকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। সিপাহী বিপ্লবের ফলে ব্রিটিশরা বুঝেছিল যে, এই অঞ্চলের মানুষকে শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে, দূর থেকে বেশিদিন শাসন করা যাবে না। শোষণ করতে হলে কাছে আনতে হবে। পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং শিক্ষার অনুগত করতে হবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এত বড় দেশ আর এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই এক হতে দেয়া যাবে না। তাই ভারতবর্ষ শাসন করতে গেলে জাতিগত বিভাজন অত্যাবশ্যক। এদের ভাগ করতে হবে ভাষায়, সংস্কৃতিতে, জাতে, ধর্মে আর অর্থনীতিতে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ এবং এর আগের ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহে ধর্ম কোনো বিভেদ আনেনি। বরং ধর্মের ওপর আঘাত আসার কারণেই হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে বিদ্রোহ করেছিল। ফকির-সন্ন্যাসীরা সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করে জীবন কাটাতেন। তাদের অপরাধ ছিল তারা নবাব মীর কাশিমকে সাহায্য করেছিলেন এবং আধ্যাত্মিক মতবাদ প্রচার করতেন যেখানে খ্রিস্টান ধর্মের কোনো স্থান ছিল না। এর ফলে কোম্পানি ফকির-সন্ন্যাসীদের ভিক্ষাকে বেআইনি ঘোষণা করে ধরপাকড় শুরু করে। সিপাহিরাও বিদ্রোহ করেছিল মূলত ধর্ম রক্ষার্থে। বন্দুকের নতুন কার্তুজ মুখ দিয়ে ছিঁড়তে হতো। জানা গেল তাতে শূকর আর গরুর চর্বি মেশানো থাকে। অর্থাৎ এই সময় পর্যন্ত আন্দোলনগুলো ছিল অসাম্প্রদায়িক, সর্বভারতীয় এবং শুধু ব্রিটিশবিরোধী। এটাই ছিল ব্রিটিশদের মূল উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই আন্দোলনগুলো সফল না হওয়ার মূল কারণ এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর সাধারণ মানুষ অংশ নেয়নি। ভবিষ্যতের যে কোনো আন্দোলনে তারা যোগ দিলে সেটা বিপজ্জনক হতে পারে। তাই এই শ্রেণিকে অনুগত করতে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলো ইংরেজি ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে। আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে উৎসাহ দেয়া হলো রাজনৈতিক দল গড়ার। ব্রিটিশদের উৎসাহে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলো সর্বভারতীয় কংগ্রেস। যাতে এই শিক্ষিত শ্রেণি নিজেদের মত প্রকাশের একটা জায়গা পায়। কয়েক কোটি জনগণকে বিচ্ছিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টার থেকে বুদ্ধিমানের কাজ তাদের কয়েকজন নেতা তৈরি করে সেই নেতাদের প্রভাবিত করা এবং তাদের মাধ্যমে পুরো দেশের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আর কোনো কারণে সেসব নেতাকে পছন্দ না হলে, ‘দলের ভেতর গণতন্ত্রের’ কথা বলে অন্য কাউকে বসিয়ে দেয়া। কিন্তু এই পদ্ধতি বেশিদিন কাজে দেয়নি। কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে এবং আরো কিছু অরাজনৈতিক ব্যক্তির প্রভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বাড়তেই থাকে। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পুনরায় ভাঙার জন্য আরেকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ‘মুসলিম লীগ’ গড়ে উঠল ১৯০৬ সালে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যেই আন্দোলন ছিল সেটা অনেকাংশে নিজেদের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িতে রূপ নিল। ‘এই সময় যদি এসব নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগি পুরুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। এই সময় যখনই কোনো মুসলমান নেতা মুসলমানদের জন্য ন্যায্য অধিকার দাবি করত তখনই দেখা যেত হিন্দুদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত, এমনকি গুণী সম্প্রদায়ও চিৎকার করে বাধা দিতেন। মুসলমান নেতারাও পাকিস্তান সম্বন্ধে আলোচনা এবং বক্তৃতা শুরু করার পূর্বে হিন্দুদের গালি দিয়ে শুরু করতেন’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠাঃ ২৩-২৪)। দলের ভেতরের ক্ষমতা লোভী প্রতিক্রিয়াশীলরা কংগ্রেস অথবা মুসলিম লীগকে কখনোই সর্বস্তরের মানুষের দলে পরিণত হতে দেয়নি। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সিভিল সাপ্লাই মিনিস্টার। দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন। সে সময় তার নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে শেখ মুজিব দরিদ্র এবং নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-কষ্ট খুব কাছে থেকে দেখে ছিলেন এবং বুঝে ছিলেন সাম্প্রদায়িক আর স্বার্থপর গোষ্ঠী দিয়ে শুধু বিভাজন হবে। দেশের সাধারণ মানুষের প্রকৃত উপকার সম্ভব না। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁর হুকুমে অসংখ্য মানুষ জুলুম সহ্য করে আন্দোলন করেছে, জেল খেটেছে, নিজের সর্বস্ব দলের জন্য দিয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। তিনি একমাত্র নেতা যিনি দেশের সর্বস্তরের মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তার মৃত্যুর পরও রিকশাচালক হাসেমের মতো সাধারণ মানুষ তাকে প্রাণ ভরে ভালোবেসেছেন। সাধারণ মানুষকে এত বেশি প্রভাবিত- বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর একজনই করতে পেরেছেন তিনি তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। এটা কাকতালীয় না বরং বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা একই কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা দুজনই তাদের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সব শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের দল হিসেবে সাধারণের কাছে নিতে পেরেছেন। মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, শেখ হাসিনা সাধারণ কোনো নেতা নন। ক্ষমতায় আসার আগে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে এসে মানুষের জন্য আন্দোলন করেছেন। আর সেই আন্দোলনে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে সর্বসাধারণের জন্য কাজ করার স্পৃহা ছিল অধিক। ক্ষমতায় এসে তিনি সব সেক্টরে দেশের এত বেশি উন্নয়ন করেছেন, যা আগে কেউ করতে পারেনি, এমনকি করার পরিকল্পনাও করতে পারেনি। এর ফলে তিনি বরাবর কিছু মানুষের ঈর্ষার কারণ হয়েছেন। কিন্তু একের পর এক দেশি-বিদেশি বিরোধিতা আর তৎপরতা উপেক্ষা করে তিনি দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে তাদের দলের মূল লক্ষ্য সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নয়ন এবং বুর্জোয়া ও শাসক শ্রেণির অন্যায় থেকে দেশের খেটে খাওয়া মানুষকে রক্ষা করা। ৭৩ বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই দুই নেতার হাত ধরে একটি রাজনৈতিক দল থেকে সত্যিকারার্থে মানুষের আবেগে পরিণত হয়েছে।

সালমান হাসান ডেভিড : পরামর্শক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন এন্ড এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App