×

মুক্তচিন্তা

‘শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা’ কি ‘মিথে’ পরিণত হয়েছে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২২, ১২:৪৪ এএম

কিছুদিন ধরে একটা তীব্র মানসিক কষ্ট নিয়ে দিনাতিপাত করছি। বুকের মধ্যে তীব্র রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মাথা উঁচু করে সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এক একজন শিক্ষক একটি জাতির ভবিষ্যৎকে তৈরি করে। তাই শিক্ষককে বলা হয় ‘দ্বিতীয় জন্মদাতা’। কেননা মা-বাবা একজন মানুষের জৈবিক জন্ম দেন; কিন্তু একজন শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে মানুষের জন্ম দেন। একজন জৈবিক মানুষ ক্রমান্বয়ে প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন একজন শিক্ষক। তাই শিক্ষককে দ্বিতীয় জন্মদাতা বলা হয়। আর শত শত বছর ধরে শিক্ষক এ মহান ও গুরু দায়িত্বটি পালন করেন বলেই, মানব সভ্যতায় শিক্ষকের ‘সামাজিক মর্যাদা’ বলে একটা বিষয় সমাজে জারি আছে। আমরা যে যত বড়ই হই না কেন, আমরা সবাই কোনো না কোনো শিক্ষকের শিক্ষা নিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছি। সুতরাং শিক্ষার্থীর জীবনে শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য এবং অবিস্মরণীয়। তাই শিক্ষকের মর্যাদার জায়গাটি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশে তথা এতদঞ্চলেও শত শত বছর ধরে শিক্ষকের মর্যাদা সমাজের বিভিন্ন রীতিনীতির মতোই একটা মর্যাদার সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। কেননা, শিক্ষকের এ মর্যাদার বিষয়টি হুট করে আকাশ থেকে পড়েনি কিংবা মাটি থেকে হঠাৎ করে গজিয়ে উঠেনি। সমাজের অভ্যন্তর থেকে শত শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় আমরা শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের নীতি নৈতিকতার বোধ এবং উপলব্ধিতে প্রতিষ্ঠিত করেছি। অথচ কিছুদিন ধরে সামাজিকভাবে একের পর এক শিক্ষকদের যেভাবে অপমান, অপদস্থ এবং অমর্যাদা করা হচ্ছে, তাতে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছি। বিশেষ করে, আশুলিয়ায় একজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে যখন পিটিয়ে হত্যা করল, তখন একজন শিক্ষক হিসেবে ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। আমরা কোথায় আছি? আমরা কোথায় যাচ্ছি? সমাজের পতন কতটা হলে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলে… এসব ভেবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি! সত্যিকার অর্থে পুরো বিষয়টি ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। আরো কষ্ট দিচ্ছে, এটা ভেবে যে, সাভারের আশুলিয়ার চিত্রশালায় এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে হত্যা করার প্রতিবাদ করছেন শুধু শিক্ষকরা; কিন্তু কেন? সমাজের সর্বস্তর থেকে কেন এর তীব্র প্রতিবাদ হচ্ছে না? প্রতিবাদের এ চরিত্র শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি সমাজে আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছে। আমি নিজে শিক্ষক সেজন্য কি কষ্ট পাচ্ছি? আমি যদি শিক্ষক না হতাম, তাহলে কি এ ঘটনা আমার মধ্যে এ ধরনের কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করত? সমাজে নিত্যদিনের আর ১০টি খুনের ঘটনার মতো এটাও কি একই রকম? একজন শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষককে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে- এটা কি কেবলই একটি সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড? এসব প্রশ্ন আমাকে তীব্রভাবে ভাবাচ্ছে আর বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্নভাবে শিক্ষকদের অপমান, লাঞ্ছনা এবং অমর্যাদার শিকার হতে হয়েছে। তাও এসব ঘটনার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে সেটা আমাদের নজরে এবং গোচরে আসে। এরকম কত ঘটনা যে আমাদের নজরে আসে না তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ পিয়ার সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রকাশ্যে সবার সামনে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনা সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। সমাজের সর্বস্তর থেকে এ ঘটনার তুমুল প্রতিবাদ উঠে আসে। এবং আমরা তখন লক্ষ করেছিলাম, সমাজে এখনো ‘শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা’ বলে কিছু একটা আছে। তাই একজন শিক্ষক অপমানিত হওয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছিল, গোটা সমাজ অপমানিত হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলা সে ঘটনার পর আমরা আশা করেছিলাম ভবিষ্যতে শিক্ষকদের অপমান করার বিষয়টি সমাজের অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বিধিবাম! আমরা দেখলাম, একের পর এক শিক্ষকদের নানাভাবে অপমান করা, লাঞ্ছিত করা, জেলে পুরে দেয়া, এমনকি হত্যার ঘটনা ঘটছে। মুন্সীগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঘটনা আমরা জানি। হৃদয় মণ্ডলকে জেলে পুরে রাখা হয়েছিল। অতিসম্প্রতি নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে ব্যাখ্যাতীত অপমান করা হয়েছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি? সর্বশেষ ঘটনা হচ্ছে, আশুলিয়ায় একজন শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষককে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ লেখা যখন লিখছি, তখন খবর পেলাম, কক্সবাজারের পেকুয়ায় ক্লাস চলাকালীন সময়ে মাদ্রাসায় ঢুকে একজন শিক্ষিকাকে ইট দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে এক দুর্বৃত্ত। তার অর্থ হচ্ছে, শিক্ষকরা ক্লাসের ভেতরও নিরাপদ না। অথচ একজন শিক্ষকের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হওয়ার কথা ছিল তার শ্রেণিকক্ষ। একজন শিক্ষকের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হওয়ার কথা তার শিক্ষার্থী। অথচ সে শিক্ষার্থীর হাতেই একজন শিক্ষককে তার জীবন দিতে হয়েছে। পুরো ঘটনাটাই অত্যন্ত বেদনার, লজ্জার এবং ঘৃণার। উৎপল কুমার সরকারের অপরাধ কী ছিল? বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, উৎপল কুমার সরকার স্কুলের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান। হত্যাকারী ছাত্র আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ ছিল। উৎপল কুমার আশরাফুলকে ইভটিজিং না করার জন্য কাউন্সিলিং করেছিলেন। শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হিসেবে তিনি তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন এবং একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি তার নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ এজন্য একজন শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যে শিক্ষার্থীই একজন শিক্ষকের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা হওয়ার কথা সেখানে সে শিক্ষার্থীর হাতেই একজন শিক্ষককে জীবন দিতে হলো। তাই, এটাকে কেবলই একটি বিচ্ছিন্ন এবং সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনায় নিলে আমরা সমাজের ক্রমপতনশীল নৈতিক অধঃপতনকে কখনই বুঝতে পারব না। এটাকে সমাজের পতনের একটা নগদ নমুনা হিসেবে দেখতে হবে। ২৮ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎপল কুমার সরকার হত্যার প্রতিবাদে এবং বিচার চেয়ে একটা মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রতিবাদ জানাতে আমিও গিয়েছিলাম। আমি সেখানে বলেছিলাম, আমরা সভ্যতার একটি চরম অন্ধকার পর্যায়ে বাস করছি, যেখানে একজন ছাত্রের হাতে একজন শিক্ষককে খুন হওয়ার চিত্র দেখতে হয়। এ ঘটনা শুধু সাধারণ কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নয়। সভ্যতার অগ্রগতিকে টেনে-হিঁচডে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা নিদর্শন হিসেবে এটাকে দেখতে হবে। তাই কেবল দোষীকে গ্রেপ্তার করে বিচার দাবি করলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। এ সমাজকে নতুন করে রূপান্তরের পরিকল্পনা করতে হবে যেখানে সত্যিকার অর্থেই শিক্ষকের মর্যাদা সুরক্ষিত থাকবে। একজন শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, এটা অত্যন্ত লজ্জার, ঘৃণার এবং অপমানের। এ লজ্জা শুধু উৎপল কুমার সরকারের একার নয়, এ লজ্জা শুধু শিক্ষক সমাজের নয়; বরঞ্চ এ লজ্জা এদেশের ১৭ কোটি মানুষের।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App