×

মুক্তচিন্তা

অর্জন কি ভাসিয়ে নেবে অন্যায়?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২২, ১২:৪৩ এএম

একজন আত্মপ্রত্যয়ী নেতার দরকার ছিল আমাদের। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন সব মানুষের জয়জয়কার যারা নেগেটিভ। এরা কোনো কিছুই সহজভাবে নিতে পারে না। এমনকি দেশের সুনাম নিয়েও এরা ভাবে না। দুনিয়ার কোনো দেশে এমনটা দেখবেন না। এই যে ভারত পাকিস্তান এই দুই দেশ নিয়ে বাদ-বিসংবাদ, আলাপ-আলোচনা, তাদের দেশের মানুষ কিন্তু নিজেদের মানসম্মান নষ্ট হোক এমন কোনো কাজ করে না। স্বাধীনতার পর থেকে এক শ্রেণির বাঙালির বিকৃত মানসিকতা দিন দিন বেড়েছে বৈ কমেনি। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে আমি নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সবকিছু মনে আছে আমার। চারদিকে হঠাৎ এমন সব আগাছা আর ডালপালা গজিয়ে গেল যেন দেশ স্বাধীন করাটাই ছিল অপরাধ। ৭৫ আর আগস্ট দেখেছি আমি। সাধারণ মানুষের মনে যাই থাকুক সে দিন আওয়ামী লীগ ছিল অসহায়। নেতাদের বেশির ভাগই হয়ে গিয়েছিল মোশতাকের হাতের পুতুল। সে আমলটায় নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্য মরিয়া দালাল শ্রেণি আজো দমেনি। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যার মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানের ছায়া রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা সার্থক হয়নি। এরা ভাবতেও পারেনি আওয়ামী লীগ ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াতে পারে। এরা ভাবেনি বঙ্গবন্ধুকন্যা এই দেশ শাসন করে বাংলাদেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবেন যা অভূতপূর্ব। আজকের বাংলাদেশ শেখ হাসিনার পরিশ্রম আর একক নেতৃত্বের ফসল। যা অনেক অর্জনে সমৃদ্ধ। এত অর্জন আর সাফল্যের পরও আমাদের সমাজে শান্তি নেই। আজকাল সবকিছু কেমন জানি পাগল বা বিকৃতদের দখলে। সামাজিক মিডিয়া উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে এই পাগলামি বা ক্রেজ রোগে পরিণত হয়ে গেছে। আমি আমরা কেউই এর বাইরে না। যে যা পারছে, যার যা আছে, তা নিয়ে বিখ্যাত হওয়ার নেশায় মত্ত। এই মত্ততার নিদারুণ নির্লজ্জ উদাহরণ পদ্মা সেতুর নাটবল্টু খুলে নেয়া। কতটা পাগল আর মস্তিষ্ক বিকৃত হলে এটা করা সম্ভব? কিন্তু করেছে। শুধু করেই চুপ থাকেনি। লাইক, লাভ বা ভাইরাল হওয়ার আশায় তা প্রচারের জন্য ভিডিও করা হয়েছে। খবরে দেখলাম তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধের সাজা না জানলে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। যাবজ্জীবন এমনকি চাইলে আরো ক্যাপিটাল কোনো পানিশমেন্ট দিতে পারে আইন। বিচারে কী হবে জানি না, তবে এই লোক যে মানসিক বিকারগ্রস্ত উন্মাদ সমাজের এক নিকৃষ্ট উদাহরণ, সেটা বলে বোঝানোর দরকার দেখি না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই আজকাল এমন কাজ করার হিড়িক পড়ে গেছে। আরেক উন্মাদ নবনির্মিত সেতুতে প্রকৃতির ডাক সামলাতে সাড়া দিয়ে ছবি তুলেছে। এই বিকৃতি আসলে কিসের ইঙ্গিত? এসব ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে আরো কিছু ঘটনা। যা আরেক ধরনের বিকৃতি। ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে। আমাদের দেশ ও সমাজের মানুষ চিরকালই ধর্মভীরু। কিন্তু এমন ধর্মান্ধতা আর ভাইরাল হওয়ার নামে অপপ্রচারের মাধ্যমে সহিংসতা আগে দেখা যায়নি। নড়াইলের প্রধান শিক্ষক স্বপন সরকারের গলায় জুতার মালা দিয়ে রাস্তায় ঘোরানোর ছবি আমরা বিদেশে থেকেও দেখেছি। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এসব ছবি দেশ ও সমাজের ভাবমূর্তি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কেন এই আক্রোশ? এটা কি স্বপন কুমার হিন্দু বা সংখ্যালঘু বলে? এই প্রশ্নটা করতে হচ্ছে কারণ আজকাল সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের ওপর বেশি বেশি আক্রমণ আর নির্যাতন দেখতে পাচ্ছি। এ ঘটনা যখন ঘটে তখন সেখানে নড়াইলের ডিসি পুলিশ সুপারসহ সবাই ছিলেন। এতগুলো বড় বড় মানুষের সামনে, কর্তাদের সামনে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল অথচ কারো মনে প্রশ্ন জাগল না পরিণাম কী হতে পারে? এ জায়গাটা ভয়ের। কারণ এরা সবাই বুঝে গেছেন নিরীহ টিচার বা সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মুসলমানের ওপর অত্যাচার অনাচার হলে কিছু হয় না। বরং এদের সঙ্গে থাকলে বা এদের হয়ে দাঁড়ালেই বিপদ। যে কারণে নড়াইলের কোনো মাননীয় এখনো মুখ খোলেননি। এমনকি সাংসদ ক্রিকেটার আমাদের সবার প্রিয় অধিনায়ক মাশরাফিও কিছু বলেছেন এমনটা শুনিনি। আপনি যদি তালিকাটা দেখেন বুঝবেন এটা পরিকল্পিত, যা এখন ক্রমেই অভ্যাসে পরিণত হতে চলেছে। শ্যামল কান্তির কান ধরা, লতা সমদ্দারের টিপ পরা, হৃদয় মণ্ডলের কারাবাস সব মিলেমিশে চূড়ান্ত পরিণতি উৎপল সরকারের জান খোয়ানো। আপনি বুকে হাত দিয়ে বলেন তো কোনটার সুষ্ঠু ও ন্যায্য বিচার হয়েছে? যদি না হয়ে পার পায় তাহলে এমন ঘটনা বারবার কেন ঘটবে না? সেটাই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়াতে চাইছে। বলাবাহুল্য পাঠক্রম আর শিক্ষক এর একটাও আর আগের জায়গায় নেই। মূল সমস্যা সেখানেও আছে। ভালোভাবে পাঠ দান আর পাঠক্রম সেক্যুলার না হলে সমাজ সেক্যুলার হবে কীভাবে? সমাজ বা জাতিকে মানুষ করে তোলে শিক্ষা। সে শিক্ষা এখন বাণিজ্য। কোচিং আর প্রাইভেট টিউশনের নামে এই বাণিজ্য বহু আগেই পথ হারিয়েছে। আমার কেন জানি মনে হয় যারা অপমানিত আর নির্যাতিত হচ্ছেন বা হবেন তাদের বড় দোষ হয়তো তারা এই বাণিজ্য প্রক্রিয়ার বাইরে। যার মানে সৎ আদর্শবান আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু এরাই এখন টার্গেট। এটা সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের এক সুগভীর চক্রান্ত। অথচ সরকারের লোকজন ব্যস্ত তাদের নিজেদের বাহবা আর স্তুতি নিয়ে। কে না জানে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে এগিয়ে চলেছে। তার গায়ে লেগেছে উন্নয়নের হাওয়া। কিন্তু পুল উড়াল, পুল রাস্তা বা সেতুই শেষ কথা না। শেষ কথা মানুষ। ভালো মানুষ। জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসর মানুষ। এদের তৈরি করে শিক্ষক। সে প্রক্রিয়া যদি ধ্বংস করা যায় তাহলে যাদের লাভ তারাই আজ মাঠে। কে বুঝছে কে বুঝছে না জানি না, তবে যারা সামাল দিতে পারে তারা গা করছে না। কথায় বলে অন্যায় অপমান বা খারাপ কিছু সংক্রামক। সেটা এখন দেখতে পাচ্ছি সবাই। মানুষ বলাবলি করছেন, লিখছেন- এর চেয়ে পাকিস্তান আমল খারাপ কী ছিল? বরং তখন এমন কিছু হতো না। কেন হতো না? কারণ তখন সরকার আর রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক বা সংঘাতমুখী হলেও মানুষ ছিল বাঙালি। এখন সরকার বা রাষ্ট্র যতই সেক্যুলার দেখাক না কেন, তলে তলে বিদ্বেষ বাড়ছে। বাড়ছে নাশকতা আর বিকৃতি। সব মিলিয়ে এমন বিকৃত উলঙ্গ সমাজ আমাদের দেশ বা জাতির জন্য অহিতকর। কেউ বুঝুক বা না বুঝুক বাংলাদেশ তা জানে আর রাতের অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কী করার আছে তার?

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App