×

জাতীয়

ত্রাণের জন্য হন্যে বন্যার্তরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২২, ০৯:১৩ এএম

ত্রাণের জন্য হন্যে বন্যার্তরা

সুনামগঞ্জের ছাতকের নোয়ারাই ইউনিয়নে বুধবার ত্রাণ নিতে বন্যাদুর্গতদের দীর্ঘ লাইন -ভোরের কাগজ

ঘাটে ঘাটে সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় > ত্রাণ ছিনিয়ে নিচ্ছেন বানভাসিরা

প্রখ্যাত সংগঠক মো. নাহিজের নেতৃত্বে হবিগঞ্জের একদল সমাজকর্মী গত মঙ্গলবার ভোররাতে সুনামগঞ্জ পৌঁছে ট্রাক থেকে ত্রাণসামগ্রী নামিয়ে ফিশারিঘাটে নৌকায় তুলছিলেন। বুধবার (২৯ জুন) সকালে পুলিশ লাইন্সঘাট থেকে অনির্বাণ লাইব্রেরির ‘কপোতাক্ষ বোট’ নিয়ে দুর্গম এলাকা তাহিরপুরে এই ত্রাণ বিলি করতে রওয়ানা দেবেন। তার আগেই সকালে একদল মানুষ এসে তাদের ওপর চড়াও হয়, তাদের ত্রাণ না দিয়ে অন্য কোথাও ত্রাণ দেয়া যাবে না। গতকাল বুধবার দুপুরে মো. নাহিজ বলেন, তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্যাকেট ত্রাণ দিয়ে তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হয়েছে। সব ঝঞ্ঝা পেরিয়ে গতকাল সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেও পৌনে ২টায়ও তারা তাহিরপুরে পৌঁছাতে পারেননি।

ঢাকার গাজীপুর এলাকার একটি গার্মেন্টস কোম্পানি ত্রাণ নিয়ে সুনামগঞ্জ আসে মঙ্গলবার রাতে। ট্রাক থেকে ত্রাণের সামগ্রী নামিয়ে নৌকা করে সুনামগঞ্জের লালবাজার থেকে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারা বানভাসি মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়ে আগে তাদেরকে ত্রাণ দিয়ে ভেতরে যেতে হয়েছে। আরেকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ না পাওয়ায় সুনামগঞ্জের লালবাজারে মঙ্গলবার মধ্যরাতে রীতিমতো সংঘর্ষ হয়েছে। এতে প্রায় ২০ জন আহত হয়।

শুধু এই দুতিনটি ঘটনাই নয়, সুনামগঞ্জের দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ না পেয়ে এভাবেই মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। বন্যা দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সরকারিভাবে অত্যন্ত সীমিতভাবে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। সারাদেশ থেকে বেসরকারিভাবে ত্রাণ বন্টন হচ্ছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যারা সুনামগঞ্জ এসে ত্রাণ বণ্টন করছেন তারাও ঠিকঠাক পথ চিনতে পারছেন না। আবার নৌকাওয়ালারা ত্রাণ বিতরণ করতে আসা লোকজনের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। এর ফলে ত্রাণ বিলিকারীদের খরচও মারাত্মকভাবে বেড়েছে। বাজেট না থাকায় অনেকেই প্রধান সড়কের পাশের লোকদের ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলে বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের অন্যতম অনির্বাণ লাইব্রেরি তাদের পর্যটক বোট ‘কপোতাক্ষ’ বন্যার্তদের জন্য হাওড়াঞ্চলে বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণ পরিবহনে সেবা দিয়ে আসছে। হুড়োহুড়ি করে ত্রাণ গ্রহণকারীরা সেই বোটের কিছু অংশ ভেঙে দিয়েছেন। তবু তারা বিরামহীনভাবে সেবা দিচ্ছেন। এর মধ্যেই মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে সুনামগঞ্জে একটানা প্রবল বর্ষণে নতুন করে পানি বাড়ছে। প্রবল বর্ষণের মধ্যেই বুধবার ভোর ৬টা থেকে ত্রাণসামগ্রী অনির্বাণ লাইব্রেরির কপোতাক্ষ বোটে উঠানো হয়। এ সময় আশ্রয় শিবিরে থাকা বন্যার্তরা কপোতাক্ষ বোট ঘিরে ধরে ত্রাণের জন্য।

বোটের সারেং ভোরের কাগজকে বলেন, বন্যায় মানুষের ভোগান্তি কমেনি। সরকারি সহায়তার বাইরেও বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন। ত্রাণ বিতরণকালে তারা নানা রকমের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ট্রলারগুলো বিশাল আকারের ভাড়া দাবি করছে। শ্রমিকরা দুই চার ঘণ্টা মালামাল লোড-আনলোডের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ দাবি করছেন এবং বাইরে থেকে যাওয়া অনেকে অপমানিত হওয়া বা শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে বাধ্য হচ্ছেন এই সব অন্যায় দাবি পূরণ করতে। ত্রাণ বোঝাই বোটকে ঘিরে ধরে হই হট্টগোল, ত্রাণসামগ্রী ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। বানভাসিদের ত্রাণ দিতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জরুরি। না হলে মানুষ ত্রাণ বিতরণে আগ্রহ হারাবে।

অনির্বাণ লাইব্রেরি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পুলিশের ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র বলেন, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ বিতরণে সুনামগঞ্জ সদর ও বিভিন্ন উপজেলায় কতকগুলো ট্রলারকে একটা পুলের আওতায় আনা, ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া, লোড-আনলোডের শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ, সমন্বয়ের জন্য কন্ট্রোল রুম স্থাপন এবং ৯৯৯ এর মতো হটলাইন নাম্বার দেয়া, লোড-আনলোডের পয়েন্ট গলিতে পুলিশ ফোর্স নিয়োগ, বিতরণের স্থানগুলোতে বিট অফিসার এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে টিম গঠন করা উচিত।

ত্রাণ না পেয়ে মানুষ কেন উত্তেজিত হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে হবিগঞ্জ থেকে ত্রাণ বিতরণ করতে যাওয়া মো. নাহিজ ভোরের কাগজকে বলেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মানুষ কেন ত্রাণ নিতে এত হন্য হয়ে উঠছে। তার মতে, ত্রাণ বিতরণে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। নতুবা কেউ ত্রাণ একাধিকবার পাবে আবার কেউ একেবারেই পাবে না। একই কথা বলেন, অনির্বাণ লাইব্রেরির কপোতাক্ষ বোটের সারেং। গতকাল তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার মধ্যে ১১টিই বন্যাকবলিত। এর মধ্যে দুর্গম এলাকাগুলোতে এখনো ত্রাণ পৌঁছেনি। যারা ত্রাণ দিতে আসছেন তাদের বললেও এসব দুর্গম এলাকায় যাচ্ছেন না।

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে সরকারের পাশাপাশি সারাদেশের স্বেচ্ছাসেবী, মানবিক মানুষ ও বিত্তশালীরা দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ত্রাণের গাড়ি প্রবেশ করছে জেলা শহরে। তবে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পরিবহনের জন্য নৌকার ভাড়া চাওয়া হচ্ছে তিন থেকে চার গুণ বেশি। এ কারণে নিরুৎসাহিত হয়ে ত্রাণ বিতরণকারীরা আশেপাশের সুবিধাজনক জায়গায় ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। ত্রাণের সুষম বণ্টন না হওয়ায় সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকার অসহায় লাখো মানুষ। এই বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি ও সমন্বয় থাকা জরুরি বলেছেন স্থানীয়রা।

প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের বেশির ভাগ এলাকা বন্যাকবলিত হয়। গত ১৬ জুন বৃহস্পতিবার ভোর ৩টায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে যায় জেলার ৮০ ভাগেরও বেশি এলাকা। গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনের তালা ভেঙে জীবন বাঁচিয়েছেন লাখো মানুষ। ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডবে ঘরে থাকা ধানচাল, গহপালিত পশু, জমিতে থাকা সবজি, পুকুরের মাছ সবই ভেসে গেছে। এখনো হাজারো মানুষের ঘরে খাবার নেই, বাইরে কাজ নেই, উঁচু এলাকা থেকে পানি কমলেও নিচু এলাকা বন্যাকবলিত। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে প্রশাসনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে সুনামগঞ্জ এসেছেন অনেকে। ত্রাণ কর্মীরা জেলা শহরে এসে বিপাকে পড়েছেন।

ট্রলার চালক ও মালিকরা সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত ভাড়া হাকাচ্ছে দূর থেকে ত্রাণ নিয়ে আসা স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে। অনেক নৌসংগঠনের নাম দিয়ে ফেসবুকেও ফ্রি সার্ভিস দেবে বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া মিলছে না।

রাঙ্গামাটির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আর্ত সারথির সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণ কুমার কর্মকার বলেন, সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে এসেছিলাম। ফেসবুকে দেখলাম তেল ও চালকের খরচ দিয়ে নৌকার ব্যবস্থা করেছে একটি নৌসংগঠন। তাদের সঙ্গে তিনদিন যোগাযোগ করলাম, পরে জানানোর কথা বলল তারা, আর জানায়নি। শেষ মুহূর্তে এসে আর ফোন ধরেনি। সহায়তার নামে সংগঠনের নাম প্রচারের প্রতারণা করছে তারা। এতে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছায়াতলের সংগঠক শহীদুল ইসলাম রাজু বলেন, কেরানীগঞ্জের বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ২১ তারিখ এক ট্রাক ত্রাণ নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ার সাহেববাড়ির ঘাটে আসি। বিশ্বম্ভরপুর যাওয়ার জন্য একটি নৌকা ভাড়া নিতে চাচ্ছিলাম। নৌকায় আমাদের জ¦ালানি দেয়াসহ ভাড়া চেয়েছে ৪০ হাজার টাকা। পরে কম ভাড়ায় আরেকটি নৌকা ঠিক করি। কিছুক্ষণ পরে সে নৌকাও যাবে না বলে জানায়। পরে আমরা বাধ্য হয়েই শহরের একটি হোটেলে অবস্থান করে আশেপাশের এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাই। নৌকা চালকদের সিন্ডিকেটের কাছে নিজেদের অসহায় মনে হয়েছে। খুব বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. সোহানা আহমেদ বলেন, সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষের জন্য প্রচুর ত্রাণ যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ অভিযোগ করছেন তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। আবার অনেকে কয়েকবার করে পাচ্ছেন। প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এ রকম হচ্ছে। ত্রাণের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। ইউনিয়ন, পৌরসভায় নাগরিকদের তালিকা রয়েছে। এই তালিকা ধরেই ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হোক।

তেঘরিয়া ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল কাদির শান্তি মিয়া বললেন, তেঘরিয়া ট্রলারঘাটে এখন আর স্থানীয় কোনো ট্রলার নেই। এজন্য আমাদের সংগঠনও সক্রিয় নয়। এই ঘাটে এখন ঢাকার পর্যটনবাহী নৌসার্ভিসই বেশি। এরা ত্রাণ নিয়ে আসা স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং প্রতারণাও করছে। মঙ্গলবার এক ট্রলার চালক স্থানীয় আরেক দালালের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা ভাড়া সাব্যস্ত করে টাকা লেনদেন করে। পরে দালাল পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে সরে গেছে। ট্রলার চালক এক পর্যায়ে যেতে পারবে না বলে জানানোয় বেকায়দায় পড়েন স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণকর্মীরা। আমি ওখানে থাকায় ধমক দিয়ে পরে ত্রাণকর্মীদের ওই নৌকায়ই তুলে দেই। এরকম অবস্থা মোকাবিলার জন্য এই সময়ে রিভারভিউ থেকে ওয়েজখালী পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে পুলিশ মোতায়েন করা উচিত। এই বিষয়ে সমন্বয় জরুরি।

সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, জেলার কোনো নৌ-ঘাটে ত্রাণ বিতরণ করতে আসা মানুষের কাছে কেউ বেশি ভাড়া চাইলে, পার্শ্ববর্তী থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। তাতেও সহযোগিতা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে, আমার সঙ্গে অর্থাৎ এসপির ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা দেব। ত্রাণ বিতরণ করতে এসে কেউ হয়রানির শিকার হলে, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App