×

মুক্তচিন্তা

পাচারকৃত অর্থ ফেরত প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২২, ০১:০২ এএম

পাচারকৃত অর্থ ফেরত প্রসঙ্গে

বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ প্রদান প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিদিন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও অন্যান্য মিডিয়ায় বক্তৃতা-বিবৃতি, তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনায় রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির মাঠেও বেশ তর্ক-বিতর্ক চলছে, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এ আলোচনা থেকে পিছিয়ে নেই। সরকার পক্ষ ছাড়া প্রায় সবাই বলছে কম হারে কর দিয়ে পাচারকৃত অর্থ বৈধ করার বিষয়টি অনৈতিক। অনেক ব্যবসায়ী নেতা বিষয়টি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করছে, তাদের কথা হলো যারা নিয়মিত উচ্চহারে কর দিয়ে আসছে তাদের জন্য এটি একটি হতাশার কারণ হবে। তাছাড়া অনেকে কর না দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে তা আবার দেশে এনে কম হারে কর দেয়ার সুবিধা নেয়ারও চেষ্টা করবে। এ রকম নানা আলোচনা-সমালোচনা শুনে সরকার পক্ষের কেউ কেউ আবার একটু পিছু হটছেন। তারা বলছেন বাজেট এখনো পাস হয়নি। সুতরাং বাজেট পাস হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বিষয়টি পুনঃবিবেচনার সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন পক্ষের বিবৃতিতে অনেকটা একই সুর প্রতিধ্বনিত হলেও বিষয়টির একটি সার্বিক বিশ্লেষণের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সার্বিক দিক বিবেচনা করে বিষয়টির একটি চুলচেরা বিশ্লেষণ এই মুহূর্তে একটি সময়ের দাবি। বিশ্লেষণের প্রথমে জানা প্রয়োজন বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা নিয়ে নীতি-নৈতিকতার যে প্রশ্নটি সামনে উঠে এসেছে এবং যা নিয়ে এত আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে তা কতটুকু প্রাসঙ্গিক। অর্থমন্ত্রী বা পরিকল্পনামন্ত্রী বা সরকার পক্ষের অন্য কেউ বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতিতে যাই বলুক না কেন বাস্তবে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য এবারের বাজেটে সরকার কি সত্যি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, এক কথায় এর উত্তর হলো না। বিষয়টি অনেকটা চিলে কান নিয়ে গেছে, সেই পুরনো গল্পের মতো, যেমন একজনকে বলা হচ্ছে চিলে কান নিয়ে গেছে আর যাকে বলা হচ্ছে সেও কানে হাত দিয়ে তা যাচাই না করে চিলের পিছু পিছু ছুটছে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কথিত আইনি পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কটি অনেকটা এমনই। বক্তৃতা-বিবৃতিতে যা বলা হয় তা হলো রাজনৈতিক বক্তব্য। এই বক্তব্য যদি বাজেট বক্তৃতা এবং অর্থবিলে না থাকে তাহলে মাঠের বক্তৃতা সম্পূর্ণই অসাড়। আবার বাজেট বক্তৃতায় যাই থাক না কেন প্রস্তাবিত অর্থ আইনে যদি এর প্রতিফলন না থাকে তাহলে বাস্তব ক্ষেত্রে ওই বাজেট বক্তৃতারও কোনো গুরুত্ব থাকে না। এমনকি বক্তৃতা-বিবৃতি এবং বাজেট বক্তৃতায় একই কথা বলা হলেও অর্থ আইনে যদি তা না থাকে তবুও তা ফলবলহীন হয়। কারণ বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা বাজেট বক্তৃতা কোনো আইন নয়। আবার ঘটনাটি যদি এমন হয়, বাজেট বক্তৃতায় যা কিছু বলা হয়েছে অর্থবিলে এর উল্টো কিছু আছে তবে ওই উল্টোটিই বাস্তবায়নযোগ্য হবে, বাজেট বক্তৃতা নয়। অনেক সময় দেখা যায় বাজেট বক্তৃতায় কিছুই বলা হয়নি অথচ অর্থবিলে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় কিছু না বলে অর্থবিলে তা ঢুকিয়ে দেয়ার এমন ঘটনা হরহামেশায় হয়ে থাকে। এবারো কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। যেমন এবারের বাজেট বক্তৃতায় কর পরিপালন সহজীকরণের কথা বলে কর রেয়াতের হার সর্বক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি করদাতার জন্য একটি ইতিবাচক খবর, এটি শুনলে করদাতা খুশি হবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত অর্থ আইনে রেয়াতযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ পূর্বের ২৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে যে ২০ শতাংশ করা হলো তা কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়নি। এটি করদাতার জন্য একটি নেতিবাচক খবর। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়, যেমন বিদ্যমান আইন অনুসারে কর রেয়াতের জন্য বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ছিল মোট আয়ের ২৫ শতাংশ কিন্তু এবারের প্রস্তাবিত অর্থ আইন অনুসারে কর রেয়াত সুবিধা প্রাপ্তির জন্য বিনিয়োগের সর্বোচ্চ হার করা হয়েছে মোট আয়ের ২০ শতাংশ। আগে একজন করদাতার মোট আয় ১০ লাখ টাকা হলে এর ২৫ শতাংশ মানে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ১৫ শতাংশ হিসাবে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা কর রেয়াত সুবিধা পেত। প্রস্তাবিত অর্থ আইন অনুসারে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মানে ২ লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হিসাবে ৩০ হাজার টাকা পাবে, অর্থাৎ পূর্ব অপেক্ষা ৭ হাজার ৫০০ টাকা কম কর রেয়াত সুবিধা পাবে। কর রেয়াত সুবিধা হ্রাস করার এই বিষয়টি কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়নি অথচ অর্থবিলের মাধ্যমে সংশোধনী এনে করদাতার এই সুবিধা হ্রাস করা হয়েছে। এভাবে বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা বাজেট বক্তৃতায় যাই বলা হোক না কেন, অর্থবিলে তা না আনা হলে কার্যত এর বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। ঠিক তেমনি বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কথা খুব আলোচিত হলেও বিষয়টি বাজেট বক্তৃতা কিংবা অর্থ আইনের কোথাও নেই। সুতরাং এটি নিয়ে যে কোনো তর্ক-বিতর্ককে একটি অনাকাক্সিক্ষত বিতর্ক বলা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো সরকার পক্ষের কেউ একবারও বিষয়টিকে অস্বীকার করছেন না। প্রশ্ন হতে পারে সরকার যদি নামমাত্র কর দিয়ে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা না করে থাকেন তাহলে এত আলোচনা-সমালোচনাই বা কেন হবে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন বটে। তাছাড়া সরকার পক্ষের নীরবতা কিংবা এক ধরনের পরোক্ষ সম্মতি এই প্রশ্নটিকে আরো জোরদার করছে। তাহলে আলোচনা করা যাক, এবারের বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে কী বলা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতার দশম অধ্যায়ে ২৪৯ অনুচ্ছেদটি এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। এখানে অর্থমন্ত্রী করোনা ভাইরাস ও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাবাসের কথা বলে বিদেশে অর্জিত অর্থ সম্পদকে অর্থনীতির মূল স্রোতে আনয়নের কথা বলেছেন। বক্তৃতার হুবহু মূল অংশটি হলো ‘বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনীত না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশস্থ অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনীত না হলে এর ওপর ১০ শতাংশ এবং বাংলাদেশে রেমিটকৃত নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে কর ধার্যের প্রস্তাব করছি। এ সুবিধা ২০২২ সালের ১ জুলাই হতে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে’। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বিদেশে অর্জিত অর্থ সম্পদকে দেশে আনা কিংবা বিদেশে থাকলে তা ঘোষণা দেয়ার কথা বলেছেন। অর্থাৎ বাজেট বক্তৃতার মূল বিষয়টি হলো বিদেশে অর্জিত অর্থ। বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনা আর পাচারকৃত অর্থ দেশে আনা এক কথা নয়। প্রস্তাবিত অর্থ বিলেও বিষয়টির হুবহু প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। বাস্তবতা হলো বিদেশে আমাদের দেশের অনেক নাগরিক অর্থ উপার্জন করেন এবং অনেকে এই উপার্জিত অর্থ দেশে আনেন আবার অনেকে আনেন না। যারা বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনেন তা আয়কর অধ্যাদেশের ষষ্ঠ তফসিলের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে কর মুক্ত বা কর অব্যাহতি যোগ্য। এদের মধ্যে দেশে যাদের আয়কর বিবরণী দাখিল করতে হয় তারা এই অর্থ করমুক্ত আয় হিসেবে এবং এই আয় দিয়ে দেশে অর্জিত স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ আয়কর বিবরণী ও সম্পদ বিবরণীতে প্রদর্শন করেন। কিন্তু যারা বিদেশে অর্জিত অর্থ সম্পদ দেশে না এনে বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হন, তারা আমাদের বিদ্যমান আইনের অস্পষ্টতার কারণে ওই সম্পদ দেশে ঘোষণা প্রদান করেন না। এবারের বাজেটে আবাসিক শ্রেণির করদাতার বিদেশে অর্জিত সম্পদ দেশে ঘোষণা দেয়ার আইনগত অস্পষ্টতা দূরীভূত করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে আবাসিক শ্রেণির করদাতা তাদের বিদেশে অবস্থিত অর্থ সম্পদ দেশে ঘোষণা দিতে বাধ্য হবেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক কাক্সিক্ষত নয়। কিন্তু বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে এনে ৭ শতাংশ হারে কর দেয়ার বিষয়টি বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিদ্যমান আইন অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনলে তা করমুক্ত হবে। কিন্তু এবারের বাজেটে প্রস্তাব এবং অর্থ আইনে আনীত সংশোধনী অনুসারে বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনলে তা ৭ শতাংশ হারে করযোগ্য হবে। ঝরী ঝপযবফঁষব ঢ়ধৎঃ-অ এর ঈষধঁংব ৪৮-এর ভাষাটি হলো- “অহু রহপড়সব বধৎহবফ রহ ধনৎড়ধফ নু ধহ রহফরারফঁধষ ধংংবংংবব নবরহম ধ ইধহমষধফবংযর ঈরঃরুবহ ধহফ নড়ঁমযঃ ধহু ংঁপয রহপড়সব রহঃড় ইধহমষধফবংয ধং ঢ়বৎ বীরংঃরহম খধি ধঢ়ঢ়ষরপধনষব রহ ৎবংঢ়বপঃ ড়ভ ভড়ৎবরমহ ৎবসরঃঃধহপব.” এখানে ঈরঃরুবহ শব্দটি দিয়ে সব নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে নাগরিকের মধ্য কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়নি, ফলে বাংলাদেশের সব নাগরিকের বিদেশে অর্জিত অর্থ বাংলাদেশে আনা হলে তা কর মুক্ত। কিন্তু এবারের বাজেট বক্তৃতা অনুসারে প্রস্তাবিত অর্থ আইনে ১৯ (এফ) নামে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ১৯ (এফ) ধারাটির টেবলে সারনি ৩-এ বলা হয়েছে অহু পধংয ড়ৎ পধংয বয়ঁরাধষবহপব, নধহশ ফবঢ়ড়ংরঃ, নধহশ হড়ঃব, নধহশ ধপপড়ঁহঃং, ঈড়হাবৎঃরনষব ঝবপঁৎরঃরবং ধহফ ভরহধহপরধষ রহংঃৎঁসবহঃং ৎবঢ়ধঃৎরধঃবফ ঃড় ইধহমষধফবংয, জধঃব ড়ভ ঞধী ৭%, এটি ঝরী ঝপযবফঁষব ঢ়ধৎঃ-অ এর ঈড়ষঁসহ ৪৮-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাই বিষয়টি চূড়ান্তভাবে অর্থ আইন পাস হওয়ার সময় বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ নতুন সংযোজিত এই আইনের কারণে ইতোপূর্বে যারা নিয়মিত অর্থ দেশে পাঠাত তারা হয়রানির শিকার হতে পারে। এটি অবশ্য একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু বিদেশি পাচারকৃত অর্থ দেশে আনা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা মোটেও কাক্সিক্ষত নয়। বরং এবারের প্রস্তাবিত অর্থ আইনে আয়কর আইনের ৮০ ধারা সংশোধন করে অষষ ধংংবঃ-এর স্থলে খড়পধষ ধহফ এষড়নধষ ধংংবঃ প্রতিস্থাপন করে দেশে ও বিদেশের সম্পদ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই ঘোষণা শুধু আবাসিক করদাতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হয়েছে। অনাবাসি করদাতার বিদেশে রক্ষিত সম্পদ ঘোষণার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সব শ্রেণির নাগরিকের জন্য দেশে বিদেশের সব সম্পদ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হলে স্বচ্ছতা আরো নিশ্চিত হতো। অনাবাসি বাংলাদেশিকে বিদেশে অবস্থিত সম্পদ ঘোষণা দেয়া থেকে কেন বাদ রাখা হলো তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু পাচারকৃত অর্থ ফেরত প্রসঙ্গ নিয়ে চলমান বিতর্ক একটি অনাকাক্সিক্ষত বিতর্ক বটে।

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী : কলাম লেখক ও আয়কর আইনজীবী। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App