×

মুক্তচিন্তা

স্পর্ধায় মাথা তুলেছে পদ্মা সেতু ব্রাভো বাংলাদেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২২, ০১:২৩ এএম

প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপরে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশের শ্লাঘার শিরদাঁড়া, আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ড- পদ্মা সেতু। সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়া যে হ্যাঁ, আমরাই পারি। সারা পৃথিবীতে তো কত সেতু হয়েছে, হয়, কিন্তু পদ্মা সেতু আলাদা কেন? প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য বাদ রেখেই বলছি, পদ্মা সেতু পশ্চিমা সভ্য দেশগুলোর মুখে বিরাশি সিক্কার কানচাপাটি থাপ্পড়। কেন? কারণ তারা পদ্মা সেতুকে রুখতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্র করে। প্রথমে এই সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্য করার কথা ছিল বাংলাদেশকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিশ্বব্যাংক বেঁকে বসে। পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশে বড় দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। নাম জড়ায় বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের। ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরেও যায় বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ সরকারও বিশ্বব্যাংককে আর এ নিয়ে কোনো উপরোধ-অনুরোধের রাস্তায় যায়নি। বরং তাদের বাদ দিয়েই কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই স্পর্ধা ‘স্বাধীন বাঙালি’দেরই মানায়। পদ্মা সেতু নির্মাণে ভীষণভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে এই সেতু বাংলাদেশকে নতুন মালায় গাঁথবে। দক্ষিণ ও উত্তরের বাধা ঘুচে যাবে এক লহমায়। সড়ক-রেল যোগাযোগ একই সঙ্গে চলমান থাকবে সেতুর মাধ্যমে। কিন্তু‘ বিশ্বব্যাংক যখন হাত গুটিয়ে নিল। বাংলাদেশজুড়ে এক অবিশ্বাসের কালো মেঘ। নাহ, আর হলো না। সমালোচনায় জল ঢেলে হাসিনা শক্ত হাতে হাল ধরলেন পদ্মা সেতুর। বিশ্বব্যাংকের সাহায্যের দরকার নেই। বাংলাদেশ নিজের টাকায় এ কাজ করবে। এ কথা বিশ্বাস করেনি বিশ্ব, অবশ্যই ভারত বাদে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ (নরেন্দ্র মোদি নয়) বলেছিলেন, আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশ এই উদ্যোগকে সার্থক করবে এবং নিজেদের আর্থিক বিনিয়োগে। কিন্তু‘ এই পাঞ্জাব কেশরী ব্যতিক্রম। কিন্তু বাকি বিশ্ব? এমনকি ভারতের বাকি নেতানেত্রীরা? নাহ, তাদের কোনো বিবৃতি নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কানাডার আদালত রায় দিল, এ মামলা চলতে পারে না। এর কোনো সারবত্তা নেই। লজ্জার মাথা খেয়ে বাংলাদেশের প্রশংসায় মাতল বিশ্বব্যাংক। সব উন্নয়নশীল দেশকে বলতে লাগল, উন্নয়ন চাও তো বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নাও। এবারে মুখ চুন বিরোধীদের। ভারত এই প্রকল্পে অংশ নেয়নি, যা খুব স্বাভাবিক ছিল না ২০১০ বা ১১ সালে। কিন্তু‘ পরে এ কথা জানা যায় যে যেহেতু এই সেতু নির্মাণে চীনের কার্যকরী ক্ষমতা ভারতের চেয়ে বেশি এবং বিশ্বের দীর্ঘতম ১০টি সেতুর ৭টিই রয়েছে চীনে, কাজেই চীনই সবচেয়ে উপযোগী দেশ এই কথা বুঝে ভারত এই নির্মাণের ধারেকাছে যায়নি। এই কাজটাও ছিল চূড়ান্ত কঠিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে আমাজান নদীর পরেই পদ্মার স্থান। পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয় এবং একই সঙ্গে এর তলদেশের মাটি খুব নরম। কাজটি এত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও ওয়েলডিং রোবট পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ এই মূল সেতুটি নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করেছে প্রায় ৪ হাজার লোক, যাদের মধ্যে প্রায় ২ হাজার চীনা নাগরিক। পদ্মা সেতুকে জলের মধ্যে ধরে রাখবে ৪২টি পিলার বা স্তম্ভ। প্রত্যেকটিই তৈরি হয়েছে মজবুত পাইল ইস্পাত দিয়ে। তবে এর পাশাপাশি এই পিলারের আর একটি বিশেষত্ব রয়েছে। জলের নিচে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়েছে এই পিলারের ভিত। পৃথিবীর আর কোনো দেশে আর কোনো সেতুর স্তম্ভ এত গভীরে নেই। পদ্মা সেতুর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ পৃথিবীর অন্য সব সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। প্রায় ১০ হাজার টন। এই ক্ষমতায় এই সেতু রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও অনায়াসে টিকে যাবে। কাজেই কারিগরি উৎকর্ষের সেরা নিদর্শন হয়ে উঠেছে এই সেতু। এই পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের নয় ভারতের অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি সিংহভাগ হয়ে থাকে মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে নদীপথ। বর্তমানে প্রায় ৪০০টিরও বেশি পণ্যবাহী ট্রাক ভারত থেকে নদীপথে মোংলা সমুদ্রবন্দরে আসে। এই বন্দরে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে থাকে দুই দেশের মধ্যে। বর্তমানে মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা, যেখানে কিনা পদ্মা সেতু দিয়ে সময় লাগবে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। এতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টায় মালামাল চলে আসবে ঢাকায়। সড়কপথে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার পর্যটক গিয়ে থাকে ভারতে। এখন ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে সময় লাগে প্রায় ১২ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে এই সময় প্রায় ৪ ঘণ্টা কমে যাবে। বর্তমানে মৈত্রী এক্সপ্রেসে ঢাকা-কলকাতা কিংবা কলকাতা থেকে ঢাকা যাতায়াতে সময় লাগে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু হওয়ায় লাগবে বড়জোর ৬ ঘণ্টা। বর্তমানে ট্রেনে আগরতলা থেকে কলকাতা যেতে সময় লাগে ৩০ ঘণ্টারও বেশি। এরপরে লাগবে মাত্র ১০ ঘণ্টা। ইউরোপের মতোই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আগরতলা অথবা অন্য কোনো রাজ্যে যাওয়া যাবে ট্রেনে। পরিবহনের যে ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের পরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল তা হলো রেলপথ। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজ রেললাইন থাকলেও পূর্বাঞ্চলের রেললাইনগুলো ছিল মিটার গেজ। ভারতের সহায়তায় তা দ্রুত ডুয়েল গেজে পরিবর্তিত হচ্ছে। আরেকটি ব্যাপার নিঃশব্দে ঘটতে চলেছে তা হলো ফরিদপুরের উত্থান। ফরিদপুরের দুই হাজার বর্গকিলোমিটারে ২০ লাখ লোকের বাস। বেশিরভাগ গ্রামে। কৃষিনির্ভর জীবন। কিন্তু‘ এই পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে ফরিদপুরের রসায়ন। পদ্মার চরে শরিয়তপুর জেলার সীমান্তে জমি নেয়া হচ্ছে। বিশাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে। দেশ-বিদেশের বিমান উঠবে-নামবে। উন্নয়নের গন্ধ পাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। যেখানেই জমি পাচ্ছেন সেখানেই কিনছেন। তারা জানেন, জমির দাম আগুন হবে। বিশ্বের কোনো অংশের থেকে আর দূরে থাকবে না ফরিদপুর। আসা-যাওয়া দুর্বার গতিতে। যেখানে চাষ সেখানেও শিল্প কারখানার পরিকল্পনা। বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ড শপ, রেস্তোরাঁ ফরিদপুরে ঝাঁপাতে তৈরি। ফরিদপুর বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র কানাইপুরে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের বৃহৎ কারখানা। যার প্রভাবে ফরিদপুরের অর্থনৈতিক কাঠামোটাই বদলাবে। ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানি এখন তাই ফরিদপুরমুখী। স্রোতস্বিনী নদীতে শ্যাওলা জমে না। নদী এগোয় অবাধে। তেজে উড়ে যায় সব বাধা। ষড়যন্ত্রের ফাঁকে আটকানোর চেষ্টা ব্যর্থ করে বাংলাদেশ ছুঁয়েছে তাদের স্বাধীনতা-উত্তর সেরা মাইলফলক। রাজনৈতিক চমক নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের সেরা অর্জন, যা চমকে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। তবে একটা প্রবাদ আছে তা হলো ‘টেইস্ট দ্য সাকসেস হোয়েন ইউ আর সাকসেসফুল’। এই সাফল্য উদযাপনে বাংলাদেশের উদ্যোগ তুলনায় কম। এই সময়ে বিদেশিদের অবাধ আমন্ত্রণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে এই সাফল্য প্রচার করা উচিত ছিল। সেই উদযাপন এই সময়ে খুব জরুরি। কারণ অর্জনেরও প্রচার প্রয়োজন। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App