×

মুক্তচিন্তা

২৫ জুন ‘জাতীয় গৌরব দিবস’ ঘোষণা হোক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২২, ১২:৪৫ এএম

আগামী ২৫ জুন ২০২২ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। মাত্র ৬ মিনিটে পাড়ি দেয়ার মতো বিশাল এই সেতু নির্মাণ যেমন বাংলাদেশের জন্য গর্বের তেমনি বিশ্বের মানচিত্রেও স্থান হয়েছে বৈচিত্র্যময় এই পদ্মা সেতুর। কারণ পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ক্রেন ব্যবহার, নদীশাসন, পাইল ও বিয়ারিংয়ের কয়েকটি আন্তর্জাতিক রেকর্ড হয়েছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং ও মোটা পাইল বসানো হয়নি। ১২০-১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর পাইল, এটিও বিশ্বে রেকর্ড গড়েছে। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রায় ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে এই পদ্মা সেতুর। সেতুতে ব্যবহৃত একেকটি বিয়ারিংয়ের ওজন ১০ হাজার ৫০০ টন। বিশ্বে কোনো সেতুতে এমন ওজনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। বিশ্বে এই প্রথম কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে, আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিলের ব্যবহার একসঙ্গে দেখা যায়নি। পদ্মা সেতু নানা কারণেই বিশ্বের বিস্ময় হয়েছে। গোটা সেতুটি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে তৈরি এবং কোনো দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সংস্থা এতে আর্থিক অবদান রাখেনি। দেশি-বিদেশি নির্মাণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই সেতু তৈরিতে বিদেশি সাহায্যও নেয়া হয়নি। কিছু মহল পদ্মা সেতু বিদেশি অর্থায়নে তৈরি হয়েছে এবং এটাকে ‘বেল্ট এন্ড রোড’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা করছে। ‘বেল্ট এন্ড রোড’ হলো চীনের উদ্যোগে শুরু হওয়া এমন এক কৌশল যাতে এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি আফ্রিকা ও ইউরোপের সড়ক ও সমুদ্র যোগাযোগ তৈরি করা হবে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় একসঙ্গে জ¦লে ওঠে ৪১৫টি ল্যাম্বপোস্টের বাতি, দেখা দেয় আলোর ঝিলিক। পদ্মা সেতুর স্প্যানের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ৭৬০ মিলিমিটারের গ্যাস সঞ্চালন। ১৫০ মিলিমিটার অপটিক্যাল ও টেলিফোন ডাক্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর বাইরে পদ্মা সেতুর ২ কিলোমিটার ভাটিতে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সঞ্চালন তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃতিতে ঘন কুয়াশা বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে অর্থাৎ আলোস্বল্পতা থাকলে বাতিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ¦লে ওঠে। মাওয়া প্রান্তে থাকছে আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র। কুয়াশা, বড় কোনো ঝড় কিংবা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে পদ্মা সেতুতে দেখা যাবে পূর্বাভাস, দুর্যোগের দুই ঘণ্টা আগেই জানা যাবে এসব তথ্য। পদ্মা সেতুর কারণে যেসব জেলা সরাসরি লাভবান হবে তার মধ্যে অন্যতম বাগেরহাট। পদ্মা সেতুর ফলে বিরাট পরিবর্তন আসছে সবুজে ঘেরা বাগেরহাটে। ইতোমধ্যে এ জেলার চিত্র সেতু চালু হতে না হতেই পাল্টে যেতে শুরু করেছে। পিছিয়ে পড়া এ জেলার অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অভূতপূর্ব উন্নয়ন শুরু হচ্ছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান সবক্ষেত্রেই পড়ছে অগ্রগতির ছাপ। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান জমি কিনছে। এখানে মোংলা বন্দর ও নির্মাণাধীন খানজাহান আলী (র.) বিমানবন্দরের ফলে জমির মূল্য অনেকগুণ বেড়ে গেছে। পুরো দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বাগেরহাটের মাছ, সবজি, ধান ও পান বিশেষ ভূমিকা রাখে। সুন্দরবন সংলগ্ন বলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ আহরিত হয়। প্রতি বছর ৫০ হাজার টন সবজি উৎপাদিত হয় এ জেলার ৫টি উপজেলায় এবং সিংহভাগই ঢাকার বাজারে যায়। দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে এই পদ্মা সেতু চালু হলে। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের আকাক্সিক্ষত অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। বহুদিনের বহু সমস্যার সমাধান তো হবেই, সেই সঙ্গে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বেকারত্ব দূরীকরণে। সবচেয়ে বড় কথা, এ অঞ্চলের পাশাপাশি গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চেহারাতেও বিরাট পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। যারা বন্দর ব্যবহার করছেন তাদের জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের চেয়ে মোংলা বন্দরের সুবিধা বেশি হবে। প্রধানত গাড়ি আমদানিতে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মোংলার সুবিধা অনেক বেশি। তুলনামূলক খরচ কম, নিরাপদে গাড়ি রাখার সুবিধার কারণেই চট্টগ্রামের চেয়ে মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আনতে ব্যবসায়ীরা বেশি আগ্রহী। যানজট ও ফেরি জটিলতার কারণে মাছ ও সবজি নিয়ে যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো পদ্মা পাড়ে। এখন এক টানে এসব মালামাল পৌঁছে যাবে ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। যে কারণে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল সহজেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাবে, ফলে কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন। কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। যার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেছে। পদ্মা সেতুর কারণে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে ভাবমূর্তির উজ্জ্বল শিখরে। নানা কারণেই এই সেতু আশ্চার্য ও গৌরবের। বিশেষভাবে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সম্পূর্ণ একশ ভাগ দেশের অর্থায়নে পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে এখন দাঁড়িয়ে আছে। সেই সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর বুকে পদ্মা সেতু এক দারুণ ও অভূতপূর্ব বিস্ময়। সবচেয়ে বড় কথা, এটি আমাদের দেশের অর্থনৈতিক গতিধারাতে আনবে আরেক আমূল পরিবর্তন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, সে কারণেই পদ্মা সেতুর বিরোধিতাকারীরা এখনো ষড়যন্ত্র করেছে। শত্রæরা বসে নেই, তাদের উদ্দেশ্য একটাই, বর্তমান জনকল্যাণমূলক সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যের অর্জনকে ভণ্ড করা। পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নের সেতু। বাঙালির গৌরবের সেতু। জাতির অহঙ্কার। একাত্তরের ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে একটা নতুন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এদেশের লাখো মায়ের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পরবর্তীতে ২০০১ সালে দেশে উন্নয়নের নতুন যাত্রা শুরু করেন। তার বর্তমানে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে, বিশেষত পদ্মা সেতু, আইসিটি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। স্বাধীনতার পর পদ্মা সেতু আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় একটি অর্জন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের এই পদ্মা সেতু। জননেত্রী শেখ হাসিনাও তার দৃঢ় সংকল্প ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে জনগণের সহায়তায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, বহির্বিশ্বের কোনো অর্থ সহায়তা ছাড়াই এত বড় একটি বিশাল স্থাপত্য তিনি নির্মাণ করতে পেরেছেন। তাই বাঙালি জাতির জন্য পদ্মা সেতু এক মহান গৌরব গাথা স্থাপত্যশৈলী। অতএব বাঙালির অন্তরে ধারণ করে রাখার জন্য ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী দিনটিকে ‘জাতীয় গৌরব দিবস’ ঘোষণা করা হোক।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : কলাম লেখক, চিকিৎসক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App