×

মুক্তচিন্তা

মানব কল্যাণে যোগ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২২, ০২:২৫ এএম

মানব কল্যাণে যোগ
যোগ মানব জাতির জন্য অন্যতম সেরা একটি উপহার। এ যোগে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার। ৪ হাজার বছরের বেশি আগে ঋষি পতঞ্জলি এ যোগ আবিষ্কার করেন। তার এ আবিষ্কার পাতঞ্জল সূত্র নামে পরিচিত। যোগ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগ ঘটায়। যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম দেহ এবং দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারি। যোগীরা প্রধানত প্রাণের সাধনা করে থাকেন। যোগীদের জন্য প্রাণ ব্রহ্ম এবং রোগীদের জন্য প্রাণ মহৌষধি। টেনশন, নৈরাশ্য, অধিক ওজন, খাদ্যাভ্যাস, বংশগত, জীবাণু প্রভৃতিই আমাদের অধিকাংশ রোগের কারণ। প্রাণ মহৌষধি প্রয়োগের মাধ্যমে এসব রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে যে রস নির্গত হয় তার সমতা বিধান হয়। ফলে দেহে আর কোনো রোগ সৃষ্টি হতে পারে না। সমতাই স্বাস্থ্য এবং অসমতাই রোগ। আমাদের দেহের প্যানক্রিয়াস থেকে যে ইনসুলিন নির্গত হয় তা প্রয়োজন মতো নির্গত হলেই আমরা সুস্থ থাকি। যদি কম ইনসুলিন নির্গত হয় তাহলে আমরা ডায়াবেটিস (বহুমূত্র) রোগে আক্রান্ত হই। আবার বেশি ইনসুলিন নির্গত হলে আমাদের দেহে সব সময় ক্ষুধার ভাব দেখা দেয়। আমরা সাধারণভাবে শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবার ৫০০-১,০০০ মিলিলিটার অক্সিজেন গ্রহণ করি, কিন্তু‘ যোগীরা প্রতিটি দীর্ঘ গভীর শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ৫,০০০-১০,০০০ মিলিলিটার অক্সিজেন গ্রহণ করেন। ফলে যোগীর দেহের সব কোষ অক্সিজেনে পূর্ণ থাকে। জীবকোষে অক্সিজেন সরবরাহের অভাবই আমাদের দেহের অধিকাংশ রোগের কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিজেনের মধ্যে কোনো জীবাণু রাখলে তা মারা যায়। এমনকি ক্যান্সারের জীবাণুও অক্সিজেনের মধ্যে বাঁচতে পারে না। যোগী দীর্ঘদিন যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে মনঃশক্তি চালনার শক্তি অর্জন করেন। দেহে কোনো স্থানে শক্তির অভাব দেখা দিলে যোগী মনঃশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সে স্থানের শক্তির অভাবটুকু পূরণ করতে পারেন। ফলে শিগগিরই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। আমাদের জীবনের জন্য সঠিক আহার এবং সঠিক বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনকে নিয়ন্ত্রণ করাকে যোগী অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি মনকে অন্তর্মুখী করে দেহের ভেতর কী ঘটছে তা জানতে চান। যোগীরা বিশ্বাস করেন যে মনের শক্তি অসীম। তারা বিশ্বাস করেন কর্মই ধর্ম, কর্মই জীবন। মানব কল্যাণই তাদের কর্মের মূল উদ্দেশ্য। যোগী তীব্র ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন হন। তার এ ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তিনি মানব কল্যাণ সাধন করেন। যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে যোগীর দেহ, মন, প্রাণ, আত্মা দিব্যতায় ভরে ওঠে। যোগ অনুশীলনে পাপের ক্ষয় হয়। ক্রমাগত অনুশীলনের ফলে যোগীর আত্মা শুদ্ধ, নির্লোভ ও নির্মল হয় এবং সাধনের জন্য উপযুক্ত হয়। পরিণামে সাক্ষাৎ নির্বাণ (মুক্তি) লাভ হয়। যোগ বলতে আমরা সাধারণত রাজযোগ বুঝে থাকি। রাজযোগ ধর্মবিজ্ঞান। ধর্মের যাবতীয় প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর প্রদানে রাজযোগ সক্ষম। রাজযোগকে আট ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার ধ্যান, ধারণা ও সমাধি। যম বলতে অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, অচৌর্য, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহকে বুঝায়। এ যম দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়। কোনোভাবেই কোনো প্রাণীর অনিষ্ট না করাকে অহিংসা বলে। অহিংসা অপেক্ষা মহত্তর ধর্ম আর নেই। সত্য দ্বারাই আমরা কর্মের ফল লাভ করি। এ সত্যের ভেতর থেকেই সবকিছু পাওয়া যায়। সবকিছু সত্যেই প্রতিষ্ঠিত। নিয়ম শব্দের অর্থ নিয়মিত অভ্যাস ও ব্রত পালন। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সব প্রকার শৌচই সাধনের জন্য প্রয়োজন। যম ও নিয়ম চরিত্র গঠনের সহায়ক। আসন বলতে বুক, গ্রীবা ও মাথা সমান রেখে দীর্ঘক্ষণ স্বাচ্ছন্দ্যভাবে বসে থাকার অবস্থাকে বোঝায়। যথা- পদ্মাসন, সিদ্ধাসন বা গোমুখাসন। প্রাণায়াম শক্তি অর্জনের উপায়। অনেকেই মনে করেন প্রাণায়াম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম। আসলে কিন্তু তা নয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টাই প্রাণায়াম। প্রাণায়ামের ক্রিয়া তিন প্রকার। যথা- রেচক, পুরক ও কুম্ভক। দেহ থেকে শ্বাস বাইরে ছাড়াকে রেচক বলে। শ্বাস বাহির থেকে দেহের ভেতরে প্রবেশ করানোকে পুরক বলে এবং শ্বাস দেহের মধ্যে বা দেহের বাইরে ধরে রাখাকে কুম্ভক বলে। গৃহীদের খুব বেশি কুম্ভক করা উচিত নয়। প্রাণায়াম ফুসফুসের ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রাণায়ামে মনঃশক্তিরূপ প্রাণের বিকারগুলোকে মানসিক উপায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন প্রাণায়ামের অনুশীলনের ফলে সাধক অষ্টসিদ্ধি লাভ করতে পারেন। তখন সাধকের কাছে অনন্ত শক্তির দরজা খুলে যায়। মন সর্বদাই কাম, রাগ, লোভ, মোহ, মদ ও পরশ্রীকাতরতা এ ছয় রিপুর তাড়নায় পঞ্চ ইন্দ্রিয় যথা- চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বকে সংলগ্ন থাকে। মনের এ বিষয়াভিমুখী গতি ফিরিয়ে অন্তর্মুখী করাকে প্রত্যাহার বলে। চিন্তার একমুখীতাই ধ্যান। ধ্যানাবস্থা মানব জীবনের সর্বোচ্চ অবস্থা। ইতর প্রাণীর সুখ ইন্দ্রিয়ে, মানুষের সুখ বুদ্ধিতে এবং দেবমানব ধ্যানেই সুখ লাভ করে থাকেন। মনের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থায়ীভাবে ধারণ করাকে ধারণা বলে। হৃদপদ্মে, মাথার কেন্দ্রে বা দেহের অন্য কোনো স্থানে মনকে স্থির করার নামই ধারণা। দীর্ঘস্থায়ী গভীর ধ্যানকে সমাধি বলে। সমাধি অবস্থায় অর্থাৎ জ্ঞানাতীত অবস্থায় সাধক জ্ঞানভূমি স্পর্শ করেন। আমাদের অধিকাংশ জ্ঞানই যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে অর্জিত জ্ঞান। এতে সত্য এবং অসত্যের মিশ্রণ থাকে। কিন্তু সমাধির জ্ঞান নির্ভেজাল জ্ঞান। সমাধিতে গিয়ে সাধক মহাজ্ঞানী হয়ে ওঠেন। সাতটি স্তরে যোগী উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। যখন জ্ঞান লাভ হতে থাকে তখন একটির পর আরেকটি করে সাতটি স্তরে আসতে থাকে। প্রথম অবস্থায় যোগী বুঝতে পারেন যে তিনি জ্ঞান লাভ করছেন। তখন সব অসন্তোষের ভাব চলে যায়। দ্বিতীয় অবস্থায় সব দুঃখ চলে যাবে। তৃতীয় অবস্থায় যোগী পূর্ণজ্ঞান লাভ করেন। চতুর্থ অবস্থান বিবেক সহায়ে সব কর্তব্যের অবসান হবে। পঞ্চম অবস্থায় চিত্ত-বিমুক্তি অবস্থা আসবে এবং যোগী বুঝতে পারবেন যে তার বাধাবিপত্তি সব চলে গিয়েছে। ষষ্ঠ অবস্থায় চিত্ত বুঝতে পারবে যে ইচ্ছামাত্রই তা স্বকারণে লীন হয়ে যাচ্ছে। সপ্তম অবস্থায় যোগী বুঝতে পারেন যে, তিনি স্বরূপে আছেন। মন বা শরীরের সঙ্গে আত্মার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আত্মার সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিল না। আত্মা একাকী, নিঃসঙ্গ, সর্বশক্তিমান সর্বব্যাপী ও সদানন্দ। আত্মা এত পবিত্র ও পূর্ণ যে তার আর কিছুরই আবশ্যকতা ছিল না। কারণ আত্মা পূর্ণস্বরূপ। এটিই যোগীর চরম অবস্থা। যোগী তখন ধীর ও শান্ত হয়ে যান। আর কোনো প্রকার কষ্ট অনুভব করেন না এবং দুঃখ আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি জানতে পারেন যে তিনি নিত্যানন্দস্বরূপ, নিত্যপূর্ণস্বরূপ এবং শক্তিমান। আজ ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’। পৃথিবীর সব দেশেই এ দিবস পালিত হচ্ছে। যোগের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করাই এ যোগ দিবস পালনের উদ্দেশ্য। পৃথিবীর সব মানুষ যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে দিব্য, যোগময় জীবন-যাপন করে সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম দেহ ও দীর্ঘজীবন লাভ করুক- আন্তর্জাতিক যোগ দিবসে এটাই প্রত্যাশা। শচীন্দ্র নাথ হালদার : কলাম লেখক; প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App