×

মুক্তচিন্তা

মেডিটেশনের ওপর স্থায়ীভাবে কর অব্যাহতি দেয়া হোক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২২, ০১:৫০ এএম

ধ্যান বা মেডিটেশন হলো মনের ব্যায়াম। মেডিটেশনের আদি ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা দেখলে সাদা চোখে একটি গুণগত পার্থক্য লক্ষণীয়। শুরুর দিকে এশীয় অঞ্চলে যেখানে ধ্যানে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে; সেখানে বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বে ধ্যানের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক, স্বাস্থ্যগত উপকারিতা এবং বৈষয়িক সাফল্য পাওয়ার বিষয়টিই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মেডিটেশনের মূল চারণক্ষেত্র প্রায় ৫ হাজার বছর আগে থেকেই। যে দেশ মেডিটেশনের অন্যতম উৎসভূমি সেই দেশেই আজ ধ্যানের ওপর ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু কেন? আমরা কি আসলে মেডিটেশনের ওপর সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানিয়েছি? মেডিটেশন আসলে কতটুকু উপকার করতে পারে? উপমহাদেশে ধ্যান গুরুমুখী বিদ্যা। পাশ্চাত্যে যারা এখন ধ্যান শেখাচ্ছেন; তাদের প্রত্যেকের জীবনের শুরুর দিকে তাকান, কোনো না কোনোভাবে তারা এই প্রাচ্য থেকেই ধ্যান শিখেছেন। ড. ডিন অরনিশ, অ্যানোডা জুডিথ; যারা এখন সোচ্চার ধ্যানের ব্যবহার নিয়ে এবং সমানতালে শিখিয়ে যাচ্ছেন- তারা শিখেছেন কোথায়? এই প্রাচ্যে। মূল মেডিটেশন ঠিক রেখে তারা শুধু বিজ্ঞানের কিছু টার্মিনোলজি প্রয়োগ করেছেন এবং তাদের ক্ষেত্রে ‘গুরু’ শব্দ বাদ হয়ে তা হয়েছে ‘PSYCHOANALYST’। সফল উদ্যোক্তা জেফ ওয়েইনার (লিংকডইনের সিইও) থেকে শুরু করে সেলিব্রিটি অপরাহ উইনফ্রেহসহ মুখচেনা কর্মযোগী মানুষদের সিংহভাগই এখন কোনো না কোনো ধরনের ধ্যানের অনুশীলনের সঙ্গে জড়িত। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মেডিটেশন মূল চিকিৎসার অংশ হিসেবে স্বীকৃত এবং তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়টা অন্তত শেষ। অর্থাৎ মেডিটেশন যে বিজ্ঞানসম্মত তা ১৯৫০ থেকে নিয়ে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত এবং তা প্রায়োগিকভাবেও দেখানো হয়েছে। এখন আসলে বিভিন্ন দেশে গবেষণার বিষয় এটা কতদূর পর্যন্ত কাজ করে। শুরতেই যে গবেষণার কথা উল্লেখ করেছি তার মূল লক্ষ ছিল মেডিটেশন আদৌ মেডিকেল খরচ কমাতে পারে কিনা। ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন একটি গবেষণাপত্র নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে, শিরোনাম ছিল- ‘This Could Cut Your Health Costs by $25000 a Year, Study Finds.’ এই ‘This’ হচ্ছে মেডিটেশন বা ধ্যান। বেনসন-হেনরি ইনস্টিটিউটের রিলাক্সেশন রেসপন্স রেজিলিয়েন্সি প্রোগ্রামের আওতায় এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ডার্টমাউথ হিচকক মেডিকেল সেন্টারের ইন্টারনাল মেডিসিনের চিফ ড. জেমস স্টাহ্ল। তার দল চার বছর ধরে ৪ হাজার ৪০০ মানুষের তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন মেডিকেল থেকে এবং তাদের ৮ সপ্তাহের একটি রিলাক্সেশন মেডিটেশন, ইয়োগা অনুশীলনের আওতায় আনা হয়। এই ঘটনার পর তাদের প্রত্যেকের মেডিকেল খরচ আগের বছরের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমে যায়। ড. জেমস স্টাহ্ল দ্বিতীয় আরেকটি গবেষণা করেন, এই গ্রুপের ভেতর যাদের সরাসরি কোনো না কোনো রোগের জন্য সারা বছর ক্লিনিক্যাল সেবা প্রয়োজন ছিল। তাদের এই ক্ষেত্রে খরচ কমে ২৫ শতাংশ। উন্নত বিশ্বে যেখানে মেডিটেশনের একটি কোর্সে ন্যূনতম খরচ হয় ৫০০ ডলার (বাংলাদেশি ৪৫ হাজার টাকা), সেখানে একবার মেডিকেল ইমারজেন্সির ন্যূনতম খরচ ৪ হাজার ডলার (বাংলাদেশি ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা)। ছোটখাটো রোগ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক রোগের হিসাব থেকে দেখা যায়, একেকজন রোগী ৬৪০ ডলার থেকে ২৫ হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত প্রতি বছর মেডিকেল খরচ কমাতে পারেন শুধু মেডিটেশন প্র্যাকটিসের মাধ্যমে। ড. ডিন অরনিশ কীভাবে বিল ক্লিনটনের বাইপাস সার্জারিকে বাইপাস করিয়েছেন তা গুগল করলেই বিস্তারিত পাওয়া যায়। তার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং ইয়োগা মেডিটেশনের মাধ্যমে জীবনযাপন চিত্রই পাল্টে দিয়েছিলেন ড. অরনিশ। হালে বারাক ওবামা এখন যাওয়া-আসা শুরু করেছেন ডিনের কাছে। তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণায় হৃদরোগ প্রতিরোধে মেডিটেশনের সফল প্রয়োগ দেখিয়েছেন। বর্তমানে তার www.ornish.com ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আলঝেইমারসহ বিভিন্ন ক্রনিক রোগ প্রতিরোধে সেবাপ্রত্যাশীদের তিনি মেডিটেশন এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে World Health Organization এবং ব্রাজিলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিটেশনের ব্যবহারিক দিক নিয়ে একটি গবেষণা করে। ২০২১ সালে Frontier in Public Health নামক একটি জার্নালে তা ‘Meditation : Evidence Map of Systematic Reviews’ এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পুরো রিপোর্টটি অনেক বড়। পাঠকদের সুবিধার্থে গবেষণায় শেষ পরামর্শের সার সংক্ষেপ উল্লেখ করছি- ‘মেডিটেশন প্র্যাকটিস প্রত্যেককে আলাদা এবং সামাজিকভাবে মানুষকে শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলে। যাদের ক্রনিক রোগ ও বিভিন্ন মানসিক অসুস্থতা রয়েছে; তারা এই অভ্যাসের মাধ্যমে উপকৃত হবেন। আর ধ্যানের এই প্র্যাকটিস জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ভালো কৌশল।’ ‘Naturopathy, Yoga, Ayurveda qualify as health care, exempt from GST’ শিরোনাম রহফরধহঃরসবং-এর। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত মেডিটেশন ইয়োগা মূল চিকিৎসার অংশ করে নিয়ে কর অব্যাহতি দিয়েছে। এবং শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সংস্কার আনার প্রয়াসে দিল্লি সরকার রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়গুলোতে একটি ‘সুখী পাঠ্যক্রম’ চালু করেছে। পাঠ্যক্রমটিতে প্রতিটি শ্রেণির আগে ৪৫ মিনিট এবং পাঁচ মিনিটের ধ্যানের একটি সুখের সময় জড়িত। ৪০ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে, যার মধ্যে ধ্যান, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানসিক অনুশীলন রয়েছে। সরকারের মতে, নতুন পদক্ষেপটি হলো আধুনিককেন্দ্রিক বিভিন্ন বিষয় যেমন- সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি ও দূষণ; মানবকেন্দ্রিক শিক্ষার মাধ্যমে সমাধান করার প্রচেষ্টা। ধ্যানচর্চা এখন আর সীমাবদ্ধ নেই শুধু হিমালয়ের খাঁজে, পাহাড়ের গুহায়, নির্জন অরণ্যে, বটবৃক্ষের ছায়ায় বা সুনসান শ্মশান ঘাটের জীর্ণশীর্ণ কঙ্কালসার সাধু-সন্ন্যাসী বা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে। ধ্যানকে হাসপাতাল ঘুরিয়ে ধরে আনা হয়েছে এখন আধুনিক জেলখানায়। লক্ষ কারারুদ্ধ নয়, লক্ষ লোহার গারদে বাস করা অপরাধীগুলোর মনে ঘাপটি মারা অন্ধকার প্রবণতাগুলো দূর করে তাদের সত্য সুন্দর আলো ঝলমলে পথে নিয়ে আসা। আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, ভারত এই কাতারে তো রয়েছে, সম্প্রতি ব্রিটেনও পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে অপরাধীদের ধ্যান প্রশিক্ষণ। ধ্যান নিয়ে বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় ভ্যাটের অজুহাতে বাংলাদেশও পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় আর। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সক্ষমতা এই সময়ে প্রশ্নাতীত। প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আজ আমরা পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করতে পেরেছি। অর্থনৈতিকভাবে সফল একটি দেশকে তার অর্থের সুফল পেতে হলে নৈতিকভাবে একটি সুস্থির জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ, মেডিটেশনের ওপর স্থায়ীভাবে কর অব্যাহতি দেয়া হোক। সুস্থ চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে আমরা যেন এক মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রযোজক, ডিবিসি নিউজ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App