×

মুক্তচিন্তা

বিদেশে পাচারকৃত অর্থ-সম্পদের বৈধকরণ প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২২, ১২:৪০ এএম

বিগত ক’দিনের সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এমনেস্টি বা ক্ষমা ঘোষণার কথা। না, এটা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ প্রতিহত করার মতো এমনেস্টি বা ক্ষমা প্রদর্শন নয়, এটা হচ্ছে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে প্রত্যাগমন ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বৈধকরণের একটি পদক্ষেপ। বিধিবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিদেশে রাখার ও নগদ টাকা আনার সুবিধাপ্রাপ্তকে বিনা বাক্য ব্যয়ে ও আইনি সুরক্ষা দিয়ে ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে। এ কাজে করের হার নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির ওপর ১০ শতাংশ ও স্থাবর সম্পত্তির ওপর ১৫ শতাংশ হবে। সরকার মনে করেন এই দুঃসময়ে পাচারকৃত অর্থের প্রত্যাবর্তন আমাদের সংকট উত্তীর্ণে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। তারা আরো মনে করেন এটা জনগণের সম্পদ। অতএব যেভাবে হোক তা ফেরত আনা সরকারের আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব। তার বিপরীতে বিরোধী দল থেকে শুরু করে সিপিডি ও অন্যান্য অনেকেই এটাকে অনৈতিক, বেআইনি ও অবৈধ কর্মকাণ্ড উৎসাহের হাতিয়ার বলে চিহ্নিত করেছেন। ব্যবসায়ীরাও এই পদক্ষেপকে অনৈতিক বলেছেন এবং ভবিষ্যতে উত্তরোত্তর অনৈতিক কাজের প্রচ্ছন্ন প্রণোদনা বলে উল্লেখ করেছেন। অপ্রদর্শিত আয়কে অতীতেও কয়েকবার হালাল করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল কিন্তু সেসব পদক্ষেপ তেমন কোনো সুফল বয়ে আনেনি। এ কারণে এবং বিরোধীদের সমালোচনার তীব্রতা কমাতে সরকার অতীতে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধতা দেয়ার গৃহীত পদক্ষেপগুলো বিসর্জন দিচ্ছে; যার ফলে জমি-জমা, আবাসন ক্রয় বা শেয়ার ক্রয় করে কালো টাকা হালালের প্রথা রহিত হচ্ছে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থবিত্ত প্রত্যাবর্তনে সরকারের এই পদক্ষেপ আমি সমর্থন করি। একই সঙ্গে আমি যে কোনো অপ্রদর্শিত বা কালো অর্থ সাদাকরণের পক্ষপাতি। সে কারণে আমি আগের কিছু বিধান বলবত রাখার প্রস্তাব করছি। তবে এ ক্ষেত্রে করের হার সর্বনিম্ন রাখাই বাঞ্ছনীয়। অতীতে ৭ শতাংশ হারে কিংবা ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার প্রয়াস তেমন সফলতা না আনলেও যে একেবারে ফলপ্রসূ ছিল না তা বলা যায় না। কখনো হয়তো এটাকে নাই মামার চেয়ে কানা মামা বলা যায়। গত মেয়াদের আগের মেয়াদে কর হার কম ছিল, তাই সাদাকৃত অর্থের পরিমাণ ও করের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। তাই আমার কাছে মনে হয় সাদাকরণ প্রক্রিয়ায় প্রথম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জরিমানাসহ করের হার ও দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হলো এক ধরনের শঙ্কা। সরকার যতই প্রতিশ্রæতি দিক না কেন, কোনো না কোনোভাবে কালো টাকা সাদাকরণকারীদের পরিচিতি ও অর্থের পরিমাণ ফাঁস হয়ে যায়। আছে এমন অনেক বড় মাছের কাহিনী। চুনুপুটিরাও কিন্তু শঙ্কামুক্ত নয়। তারা মনে করে যে কোনোভাবে বিশেষত তথ্য অধিকার আইনের কারণে যে কোনো তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এই বিষয়টির যাতে একটা চূড়ান্ত সমাধান হয়ে যায়, তার ব্যবস্থা রাখলে পাচারকৃত অর্থের প্রত্যাবর্তন বাড়বে। আবার বলছি আগের মতো সব ধরনের কালো অর্থ সাদাকরণের সুযোগ এখনো থাকা উচিত। তাহলে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের চেয়ে স্বদেশে ধনাঢ্য ও ক্ষমতাবানরা অপ্রদর্শিত আয়কে সাদাকরণে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। অর্থমন্ত্রী মনে করেন আজ না হোক আগামী ১০ বছরে পাচারকৃত অর্থ তার অবৈধ গন্তব্যে সংকটে পড়বে। পি কে হালদারের ক্ষেত্রে তা ঘটতে শুরু করেছে। অতএব অতি সতর্ক পাচারকারীরা পূর্বাহ্নেই ব্যবস্থা নেবে। এসব অর্থ সাময়িকভাবে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াবে এবং একবার করজালে আবদ্ধ হলে কোনো না কোনোভাবে দেশের আয় উপার্জন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আয়কর না হোক সারচার্জের পরিমাণ বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি কমাতে প্রতি বছরই সেগুলো সহায়তা করবে। কারণ একবার আয় বা সম্পদ প্রদর্শিত হলে তা এ জীবন ও পরজীবনে সরকারি কোষাগারের আকার বাড়িয়েই চলবে। তাই নৈতিকতা ও সমতার প্রসঙ্গটি আপাতত গুরুত্ব না দিয়ে সব অপ্রদর্শিত আয় করজালে আনার পদক্ষেপটি সমর্থন করা যায়। সরকারি মতে, এই অর্থ শুধু সুদ ও ঘুষজাত নয়, অন্য কোনোভাবেও স্তূপিকৃত হতে পারে, যা সাদা করলে ব্যক্তির উৎকণ্ঠা কমতে পারে এবং পুণ্যার্জনের পথও খোলাসা হবে। এদেশে অনেকেই মনে করেন যে, পাহাড়সম পাপ করেও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তা মাফ করে দেবেন। আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে যদি ক্ষমা মিলে তাহলে সরকারকে কিছু অর্থ-সম্পদ দিয়ে পরকালের পথটা মসৃণ করার সুযোগ হয়তো অনেকে খুঁজবেন; অবৈধ আয় হালাল করার প্রবণতা বাড়বে। তাই অন্যান্য বেশ কিছু উন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের উদাহরণ টেনে বিশেষত ইন্দোনেশিয়ার সফলতার কাহিনী নিয়ে আমাদের দেশে এক বছরের একটি পরীক্ষামূলক বিদেশে পাচারকৃত অর্থ-সম্পদের বৈধকরণ প্রকল্প নেয়া যেতে পারে।

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App