×

সারাদেশ

উত্তর-পূর্বে বন্যার অবনতি : টানা বর্ষণ ও ঢলের পানি সিলেট শহরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২২, ১০:২২ এএম

উত্তর-পূর্বে বন্যার অবনতি : টানা বর্ষণ ও ঢলের পানি সিলেট শহরে

কয়েক দিনের টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিপদসীমার উপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি। ফলে সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলে অবনতি ঘটেছে বন্যা পরিস্থিতির।

এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-

সিলেট : বৃষ্টিপাত কিছুটা কমলেও উজানের ঢলের কারণে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একইসঙ্গে পানি ঢুকেছে মহানগরীর বেশ কয়েকটি এলাকায়। এতে জলাবদ্ধতার কারণে বিপাকে পড়েছেন মানুষ। সিলেট পাউবো সূত্রে জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে পানি বেড়েছে সিলেট পয়েন্টেও। সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদী বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশিদ পয়েন্টে সকালে বিপদসীমার নিচে থাকলেও ফেঞ্চুগঞ্জে বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শেরপুর ও শ্যাওলা পয়েন্টেও দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে, গোয়াইনঘাটে সারি নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কানাইঘাটের লোভা ও কোম্পানিগঞ্জে ধলাই নদীর পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, উজানে বৃষ্টি হচ্ছে, এ কারণে ঢল নামছে। ফলে নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তিনি জানান, চলতি সপ্তাহে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এর মধ্যে ১৯ ও ২০ জুন সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর ২/৩ দিন বিরতি দিয়ে ফের ২৫ জুন থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এরসঙ্গে উজানের ঢল নামা অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এদিকে পাহাড়ি ঢলে সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একইসঙ্গে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি আর অতিবৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে সিলেট নগরীতেও। নগরীর দাঁড়িয়াপাড়া, কালীঘাট, পাঠানটুলা, তালতলা, মাছুদিঘিরপাড় ছাড়াও দক্ষিণ সুরমার বেশ কয়েকটি এলাকায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লোকজন। এদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গোয়াইনঘাটের

বন্যা পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান জানান, উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

পানিতে তলিয়ে গেছে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকার শিক্ষা ও সেবা প্রতিষ্ঠান। পানি উঠেছে সিলেট-ভোলাগঞ্জ মহাসড়কেও। এতে উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপজেলা সদরের। বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় কয়েক হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। জৈন্তাপুরে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নিজপাট, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট স্কুল-কলেজ পানিতে তলিয়ে গেছে।

উপজেলার আসামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইমরান আহমদ মহিলা ডিগ্রি কলেজ, জৈন্তাপুর তৈয়ব আলি ডিগ্রি কলেজ, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বিদ্যানিকেতন, বিরাইমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডুলটিরপাড়াসহ আরো বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে পানিতে নিমজ্জিত। জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল বশিরুল ইসলামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বন্যা প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

সিলেট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, বন্যার আগাম প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রেখেছি। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রয়েছে। এছাড়া জেলার সবকয়টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) : সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার সবকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক ও সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হওয়ায় ছাতক ও তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুরমা নদীর তীর উপচে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। দোয়ারাবাজার উপজেলা পুরোটাই বন্যাকবলিত। ছাতক উপজেলায় ৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বুধবার সকালে ব্যাপক বৃষ্টির কারণে সুরমা নদীর তীর উপচে সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর, ষোলঘর, কাজীর পয়েন্ট, উকিলপাড়া, মধ্যবাজার, সাহেববাড়ি, বড়পাড়া, কালীপুর, জলিলপুর, হাসনবসত, সুলতানপুর এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ লোকজন।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলায় বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শান্তিগঞ্জ : মহাসিং, লাউয়া ও নাইন্দা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও উপজেলার ৩টি বিদ্যালয়ে ঢলের পানি প্রবেশ করায় বিদ্যালয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেছে। এদিকে পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলার দুর্বাকান্দা, উলারভিটা, মৌখলাসহ বিভিন্ন গ্রামগুলোর যাতায়াত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। শান্তিগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের শিমুলবাক-তেহকিয়া সড়ক, কাকিয়ারপাড় নোয়াগাঁও সড়ক, পার্বতীপুর-সুলতানপুর সড়ক, কামরূপদলং-আস্তমা সড়কসহ ছোট বড় গ্রামীণ রাস্তা অতিবৃষ্টির ফলে তলিয়ে গেছে। এতে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া হাওর ও নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়া অব্যাহত থাকায় অনেক এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ফলে ওইসব এলাকার মানুষজনের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ফারুক আহমদ বলেন, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির ফলে শান্তিগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, উপজেলার কিছু কিছু এলাকা নিচু থাকায় বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করছে। যাদের বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করছে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। দোয়ারাবাজার : বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এতদিন বাড়ির আশপাশে পানি থাকলেও এখন আবার নতুন করে বাড়িঘরের ভেতরে পানি প্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়ক, দোয়ারাবাজার-বাংলাবাজার সড়ক, দোয়ারাবাজার-ল²ীপুর সড়ক, নরসিংপুর-শ্যামারগাঁও, কাঞ্চনপুর-দোহালিয়া সড়কের বিভিন্ন অংশে পানি বাড়তে থাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে আবারো হুমকির মুখে পড়েছেন মাছ চাষিরা। বন্যার পানি বিভিন্ন মাছের খামারে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পানির স্রোতে অনেকের পুকুরের পাড় ভেঙে মাছ ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পুকুরের সুরক্ষায় বৃষ্টির মধ্যেই রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন মাছচাষিরা।

উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অনুকূল চন্দ্র দাস জানান, পুনরায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে। এই অবস্থায় সকল প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ এবং সার্বক্ষণিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। উপজেলার বন্যাকবলিত ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা প্রিয়াংকা বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করেছি। নতুন করে আরো ২০ টন জিআর চাল বিতরণ করেছি। ত্রাণ কার্যক্রম চলমান থাকবে।

ছাতক : উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলা সদরের সঙ্গে ১৩টি ইউনিয়নের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের অদূরে রহমতবাগ এলাকায় তলিয়ে গেছে ছাতক-সিলেট সড়ক। দুপুর থেকে সিলেটসহ সারাদেশের সঙ্গে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

ছাতক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মামুনুর রহমান জানান, উপজেলা পরিষদ চত্বর এলাকায় ও অফিসে বন্যার পানি। পরিষদের অধিকাংশ বাসায়ও পানি ঢুকে গেছে। ছাতক পেপার মিল হাইস্কুল, বৌলা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মণ্ডলীভোগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬০ পরিবার ইতোমধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রয়োজনে আরো আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হবে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সহায়তার জন্য ২৪৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় দেয়া হয়েছে ২০ টন করে। সুনামগঞ্জে ৪টি পৌরসভায় দেয়া হয়েছে ২৫ টন চাল। এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App