×

সারাদেশ

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেট আবারও বন্যা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২২, ১১:৫৪ এএম

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেট আবারও বন্যা

বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেটে আবারও ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে পানিবন্দি লোকজন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এদিকে, সিলেট নগরীর বিভিন্ন বাসাবাড়িসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নগরীর অধিকাংশ বাসাবাড়ি, অফিসপাড়া ও সড়কে হাঁটু ও কোমর সমান পানি থৈ থৈ করছে। নগরীতে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় সিলেটে সুরমা বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার, কানাইঘাটে সুরমা ১০৭ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা ২১ সেন্টি মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর, খাদিমপাড়া, টুকেরবাজার, জালালাবাদ, মোগলগাঁও, কান্দিগাঁও, হাটখোলা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বিভিন্ন হাট-বাজার, মসজিদ, স্কুল-মাদ্রাসাসহ ভিটে-বাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ক্ষেত ও বীজতলা।

সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে গতকাল বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া, গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৫৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে।

সিলেট আবহওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সিলেটে প্রচুর বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সাথে ভারি বর্ষণ হতে পারে। ২৩ জুন পর্যন্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বুধবার বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোতে আরো ২৫৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম।

কোম্পানীগঞ্জ : গত মাসে হয়ে যাওয়া বন্যার ক্ষত এখনও শুকায়নি। স্বাভাবিক হয়নি মানুষের থাকার পরিবেশ। এরই মধ্যে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। এবারও বন্যার কারণ টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। ঘরের ভেতরে পানি উঠে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার বিকেল থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত বন্যার পানি বেড়েছে। এ সময়ে ধলাই ও পিয়াইন নদীর পানি উপচে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ২০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বুধবার বিকেল পর্যন্ত তলিয়ে গেছে উপজেলার ফসলি জমি ও মাছের খামার। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। ছাতকের সাথে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলার সর্বত্র গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। পানি উঠে যাওয়ায় স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

বন্যায় তলিয়ে গেছে উপজেলা সদরের সকল সড়ক। বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসাসহ সরকারি সকল বাসভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলা ভূমি অফিস, থানা কম্পাউন্ড, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, এলজিইডি অফিস, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসসহ সরকারি-বেসরকারী বিভিন্ন অফিস জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক বলেন, ৮-১০ টি ব্যতিত উপজেলার সকল স্কুলের মাঠে পানি ঢুকেছে। এ কারণে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রায়হান পারভেজ রনি বলেন, আগের বন্যায় ফসলের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। নতুন করে শাকসবজিসহ ৫৫ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুসিকান্ত হাজং বলেন, বন্যার্তদের জন্য ৩৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। মানবিক সহায়তা হিসেবে ২৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত মাসে হয়ে যাওয়া ভয়াবহ বন্যার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারও বন্যার কবলে পড়লেন কোম্পানীগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের মানুষ। এর আগে গত ১১ মে কোম্পানীগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়।

গোয়াইনঘাট: টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে উপজেলার ৯৫ ভাগ ঘর বাড়িতে পানি উঠেছে। লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দি রয়েছেন। বিভিন্ন ইউনিয়নে ৪০ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল ৮টা থেকে সারি ও ডাউকি নদী দিয়ে বিপদ সীমার উপরে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ২-৩ ঘন্টার মধ্যে উপজেলা সদরসহ ১২ টি ইউনিয়নের ৯০শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। সারি-গোয়াইনঘাট সড়ক, গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়কসহ জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নদনদী দিয়ে বিপদ সীমার উপরে পানি প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলাবাসীর মাঝে আতংক বিরাজ করছে। বিশেষ করে দিন মজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকের ঘরে খাবার নেই। আবার অনেকের ঘরে খাবার থাকলেও চুলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রান্না করে খাবার খেতে পারছেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট বাজার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্য ও পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাহমিলুর রহমান জানান, বন্যার্তদের জন্য ৪০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তাছাড়া, ৪৪ টন চাল পানিবন্দী মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য বরাদ্দ হয়েছে বলেও জানান তিনি।

কানাইঘাট: টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আবারো সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে লোভা-সুরমা নদীর পানি বাড়তে থাকে। সুরমা নদীর প্রবল ঢলে উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের কুওরঘড়ি সুরমা ডাইকের ভাঙ্গন কবলিত এলাকা দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে উপজেলার ২নং লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম, ৫নং বড়চতুল ও পৌরসভার ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা, রাস্তা-ঘাট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারণে বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।

দুপুরের দিকে কানাইঘাট বাজারে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উত্তর বাজারের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে মালামালের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। কানাইঘাট-চতুল-দরবস্ত সড়কের বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

বিকেল ৪টায় কানাইঘাট সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ১৩৮ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পুনরায় কানাইঘাটে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়ায় উপজেলার অধিকাংশ এলাকার গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে এবং লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছেন।

পানিবন্দি অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বন্যার ক্ষয়ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বন্যা পরবর্তী নর্দমার মধ্যে বসবাস করে আসছিলাম। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এরই মধ্যে আবারো বন্যায় বাড়ি-ঘর তলিয়ে যাওয়ায় মারাত্মক দুর্ভোগের মধ্যে দিনযাপন করছি।

জৈন্তাপুর: জৈন্তাপুরে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে আবারও উপজেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। বহু বসতবাড়ি রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। নিজপাট, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট স্কুল কলেজ পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার আসামপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইমরান আহমদ মহিলা ডিগ্রি কলেজ, জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রী কলেজ, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বিদ্যানিকেতন, বিরাইমারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,ডুলটিরপাড়াসহ আরও অনেক স্কুল পানিতে তলিয়ে গেছে।

নীচু এলাকার অনেকের বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যাচ্ছেন। টানা বৃষ্টিপাতের ফলে জৈন্তাপুর উপজেলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এদিকে, জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল বশিরুল ইসলামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ বন্যা প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App