×

রাজধানী

ডেঙ্গু মোকাবিলায় কী করছে ২ সিটি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২২, ০৮:৩৯ এএম

বর্ষা শুরু হলেই বেড়ে যায় এডিস মশার প্রজনন। বাড়তে শুরু করে ডেঙ্গুর প্রকোপ। রাজধানীর প্রতিটি ভবনের বেজমেন্ট কিংবা পরিত্যক্ত পাত্র এখন এডিস মশার প্রজননস্থল। অট্টালিকা কিংবা বস্তি বাড়ি, কোথাও স্বস্তি নেই। ডেঙ্গু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়। পরিস্থিতি ঠেকাতে ঢাকার দুই সিটি কপোরেশন কতটা তৎপর? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে নগরবাসী। অন্যদিকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় বহুমাত্রিক কর্মকৌশল নিয়ে মাঠে সরব সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বর্ষায় এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। খোলা জায়গায় জমে থাকা পানিতে বাড়ে এডিসের প্রজনন। অন্য অঞ্চল থেকে রাজধানীতে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি থাকে। গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। এই মূহুর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না রাখলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৌশলগত কারণে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার বক্সকালভার্ট ও কাভার্ড ড্রেনে দুই সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। প্রধান সড়কের পাশে ওষুধ স্প্রে করেন মশক নিধনকর্মীরা। ভেতরের গলিতে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। এছাড়া অভিজাত এলাকাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়, অন্য এলাকাকে সেভাবে দেয়া হয় না। মশা মারতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৮৫ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এসব বরাদ্দের সঠিক খাতে খরচে সতর্ক থাকতে বলছেন তারা।

জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের কাগজকে বলেন, এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণ আগের দুই বছরের তুলনায় বাড়তে পারে। আমাদের সা¤প্রতিক জরিপে এ বছর এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে। এখনই সিটি কপোরেশনের ডেঙ্গু কন্ট্রোল প্রোগ্রামকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রজাতি ভেদে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হবে। করপোরেশনের উচিত, এখনই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে তাদের পরামর্শগুলো কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা।

বিগত বছরগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি মশা মারতে আগেভাগে প্রস্তুতি ও কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল। কর্মপরিকল্পনায় ডেঙ্গুর প্রাক মৌসুম, মূল মৌসুম এবং মৌসুম পরবর্তী পরিকল্পনা একসঙ্গে লিপিবদ্ধ করে মাঠে নামার ঘোষণা দিলেও চোখে পড়ার মতো কার্যক্রম নেই।

নগরবাসীর অভিযোগ, সকাল-বিকাল ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও তা ছিটানো হচ্ছে না। যে পরিমাণ ছিটানো হচ্ছে তা কোনো কাজেই আসছে না। ফলে দিনের বেলাতেও মশারি টানতে হয়। জানালা বন্ধ করে রেখেও মশার উপদ্রব কমছে না, বরং বেড়েছে। রাজধানীর সব এলাকায় ওষুধ ছিটানো হয় না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে অনেক সময় ওষুধ ছিটানো হয়। তখন মশা কিছুক্ষণের জন্য সরে যাচ্ছে। ধোঁয়া সরে গেলে ফের মশার কামড় শুরু হয়।

নগরবাসীর এমন অভিযোগ মানতে নারাজ সিটি কপোরেশনগুলো। দুই সংস্থার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মশা মারতে শুধু ওষুধ ছিটানোকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্য পদ্ধতিগুলো সমন্বয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জরিপ ও নিরীক্ষণ জোরদার, গবেষণাগার ও র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠনের পাশাপাশি বিশেষ পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে কীটতত্ত্ববিদদের সহায়তায় জরিপ চালানো হবে। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। নিয়মিত ঔষুধ ছিটানো হচ্ছে। দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে মাঠপর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম পরিদর্শন, তদারকির জন্য ‘মশক নিধন সেল’ গঠন করা হয়েছে।

ডেঙ্গু ঠেকাতে ডিএনসিসির তৎপরতা : ডেঙ্গু প্রতিরোধে ডিএনসিসি প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইডিং এবং বিকালে ফগিং করছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে মাইকিং করা, লিফলেট টানানো হচ্ছে। প্রতি শনিবার স্লোগানের মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এডিস মশার লার্ভা নিরসনে সব প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হচ্ছে।

ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এডভোকেসি সভার মাধ্যমে ইতোমধ্যে এডিস নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিজস্ব কর্মীদের পাশাপাশি ওয়ার্ড পর্যায়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা ১০ জন মশক নিধনকর্মীর মধ্যে পাঁচজন ফগার ও স্প্রে মেশিনের সাহায্যে মশার লার্ভা ও উড়ন্ত মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

এছাড়াও বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপো, পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন বাড়ি, মেট্রোরেল প্রকল্প, চিড়িয়াখানা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, থানার পরিত্যক্ত গাড়ি ইত্যাদি স্থান ও স্থাপনা পরিদর্শনে আলাদা টিম প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী, মসজিদের ইমাম, বাড়ি মালিক সমিতির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমপক্ষে একটি এডভোকেসি সভার পরিকল্পনা আছে। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ইমামদের মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত বার্তা প্রচার করা হচ্ছে।

মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই কাউন্সিলরদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার সমন্বয় সভা করার নির্দেশ দিয়েছেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এডিস মশার প্রাদুর্ভাব ও ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমরা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। তবে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সহযোগিতা করতে হবে। সবাই মিলে ‘১০ টায় ১০ মিনিট প্রতি শনিবার, নিজ নিজ বাসাবাড়ি করি পরিষ্কার’ স্লোগানটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে চলমান সামাজিক আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হবে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী মো. সেলিম রেজা বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে ডিএনসিসির রিসোর্স বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ডিএনসিসির ৪০০০ কর্মী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। ডেঙ্গুর সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র (হটস্পট) ধ্বংস করতে চিরুনি অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়া ডেঙ্গু নিধনের কার্যকরী ট্যাবলেট ‘নোভানিউরন’ বাড়ি বাড়ি বিতরন করা হবে। এরপরও কেউ সচেতন না হলে আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানা করা হবে।

ডেঙ্গু ঠেকাতে ডিএসসিসি তৎপরতা : মশক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পিত রূপরেখা অনুসরণ করে সমন্বিত লড়াইয়ের অংশ হিসেবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত মানসম্মত কীটনাশকের ব্যবস্থা করেছে ডিএসসিসি। এছাড়া আজ বুধবার থেকে ১০ আগামী ৪ মাস ডেঙ্গু রোধে ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রম চলবে।

চলতি মাসে স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে আঞ্চলিক পরামর্শ ও অবহিতকরণ সভার আয়োজন করবে ডিএসসিসি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করবে সংস্থাটি। মাসের শেষের দিকে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে জরিপ চালানো শুরু করবে ডিএসসিসি।

চলতি মাসে কীটনাশক ও যন্ত্র সংগ্রহ, প্রচারপত্র ও স্টিকার বিতরণের কাজ শুরু করেছে ডিএসসিসি। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক ও ওয়ার্ড – এই তিন পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক সভা করা হবে। এর মধ্যে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতি সপ্তাহে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভা করা হবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতি মাসে ন্যূনতম ৩টি প্রতিষ্ঠানে সভা এবং মার্চ, জুন ও সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সভা করবে ডিএসসিসি।

এসব বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মপরিকল্পনায় রদবদল এনেছি। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল, আধুনিক মেশিনারিজ এবং পর্যাপ্ত ভালো মানের কীটনাশক দিয়ে ডিএসসিসির আওতাধীন ৭৫টি ওয়ার্ডে সারাবছর দৈনিক ভিত্তিতে সুসমন্বিত কার্যক্রম চলবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App