×

জাতীয়

ভারতের সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে সতর্ক ঢাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২২, ০৮:১৫ এএম

ভারতের সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে সতর্ক ঢাকা

ভারত ও বাংলাদেশ

ভারতের সঙ্গে ‘বহুমাত্রিক’ সম্পর্কের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। দুই দেশের বন্ধুত্বের এই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সতর্কতার সঙ্গে এগুচ্ছে ঢাকা- যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কে জড়িয়ে তা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উন্নতির জের ধরেই প্রতিবেশী দেশ দুটি একসঙ্গে বড় পরিসরে পথ চলতে শুরু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও কানেকটিভিটিতে বড় ধরনের অগ্রগতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরেও সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। তার আগে চলতি সপ্তাহেই জেসিসি বৈঠকে অংশ নিতে দিল্লি যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি নানা ঘটনা ঘটলেও ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশ যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি বিশ্লেষণ করে বিশেষ করে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের পর ঢাকার নীরবতা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটিতে (আইপিইএফ) যোগ দেয়া না দেয়ার বিষয়কে কেন্দ্র করেই ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের এই বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও এওএফএর সভাপতি শমসের মবিন চৌধুরী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকা-দিল্লির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির কারণে এখন বহুমাত্রিক বা বহুপক্ষীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ কারণে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক এখন সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ভারতও সম্পর্কটি সুদৃঢ় করার জন্য আগ্রহী বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তবে এই সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক লাভ এবং সমমর্যাদার ভিত্তিতে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ জমির গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্কে একটি পরিবর্তন আসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের আদ্যপান্ত এখনই বলা ঠিক হবে না। কারণ আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। সেতু উদ্বোধনের পর তিনি সেই সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন বলে মন্তব্য করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে গত মে মাসে গুয়াহাটিতে নদী সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সম্মেলনটি আয়োজন করা হলেও এর নেপথ্যে ছিল- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো। ওই সম্মেলনে আসিয়ানভুক্ত বহু দেশও অংশ নিয়েছিল। দুই দিনব্যাপী ওই সম্মেলনের পরই ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটিতে (আইপিইএফ) যোগ দেয়ার ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের বিষয়টি সামনে চলে আসে। সম্মেলনের পরই চীন বিবৃতি দিয়ে জানায়, কোনো ধরনের ‘ব্লক কূটনীতিতে’ বাংলাদেশের যোগ দেয়া উচিত হবে না। এর কয়েকদিন পরই ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতও আইপিইএফে যোগ না দিতে বাংলাদেশকে সতর্ক করে। কিন্তু বাংলাদেশ চীনা দূতের কথার কোনো উত্তর দেয়নি। তবে এটা ঠিক সম্প্রতি চীনের অর্থনৈতিক সহায়তার বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে হাঁটছে ঢাকা। এরই মধ্যে উচ্চগতির ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের বিষয়ে চীনা একটি প্রস্তাব বাতিল করেছে সরকার। চীন এই প্রকল্পটি বেশ আগ্রহের সঙ্গে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক ছিল। চীনকে সতর্কভাবে দূরে সরানোকেও ভারতের সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং নেপালের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ চীন সম্পর্কে পরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে কূটনীতিকরা মনে করছেন।

এ বিষয়ে রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটিতে (আইপিইএফ) যোগ দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে কিনা, সে জন্য এর বিভিন্ন দিক আমরা পর্যালোচনা করছি। আইপিইএফের বিষয়ে চীনের আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঢাকা এই ফোরামে যোগ দেবে কিনা, সে বিষয়ে বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে। আমরা শুধু আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে যা করার করব। চীনের বিরোধিতার প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আমরা কারো কথায় যোগ দেব না, যোগদানে বিরতও থাকব না। এটি যদি আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে থাকে ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা হয়, তবে যোগ দেব। কে কী ভাবল তা ভেবে লাভ নেই।

এদিকে গতকাল সোমবার এসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড বিসিএস (ফরেন অ্যাফেয়ার্স) অ্যাম্বাসেডার্স (এওএফএ) নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে মাসিক বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বৈঠকে আসিয়ানের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আসিয়ান নিয়ে আলোচনার সময় আইপিইএফের বিষয়টিও এসেছে। বৈঠক শেষে এওএফএ’র সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এখন শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে না। এখন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে ভূমিকা রাখার সময় এসেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এটি কোনো সামরিক ফ্রেমওয়ার্ক নয়। নিতান্তই অর্থনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক। ১৩টি দেশ ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু করেছে। এর মধ্যে ৭টি আসিয়ান দেশ। ওই সব দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অভিবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলে তিনি জানান। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা যদি আগেভাগে আলোচনায় যুক্ত হতে পারি তবে এটির নিয়ম-কানুন ঠিক করার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারব। বিশ্লেষকরা বলেছেন, সম্প্রতি মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে মুসলিম বিশ্বের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও তোপের মুখে পড়েছে ভারত। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামী বিশ্বের অংশীদারদের শান্ত করার চেষ্টা করতে বাধ্য হয়েছে নয়াদিল্লি।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশ ভারতের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। এসব দেশ ভারত ও বিজেপি সরকারের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দেশটিকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশ এমন কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে একটি যারা মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিজেপির মুখপাত্রদের অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানায়নি। এ বিষয়টিও ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে নতুন ইঙ্গিত দিচ্ছে।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত শনিবার সফররত ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদলকে বলেন, যারা মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ সরকার।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, চীনা নির্মাতা সংস্থা পদ্মা সেতু নির্মাণ করলেও বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে এই খাতে কোনো ঋণ নেয়নি। তবে এটা ঠিক, এই সেতুটি নির্মাণে ভারতের কোনো ভূমিকা না থাকলেও এখন দিল্লি ভাবছে, এই সেতু ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত রেল ভ্রমণের সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা কমিয়ে বাংলাদেশকে ভারতের আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এতে ভারত-বাংলাদেশে দুই দেশের অর্থনীতিতেই অবদান রাখবে। আর ঠিক এখানেই দুই দেশের নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

একাধিক সূত্র বলেছে, আগামী সেপ্টেম্বরে ভারত সফরের কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বাংলাদেশে আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে সম্ভবত এই সফর হবে দুই সরকারের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের শেষ যোগাযোগ। কাজেই উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে কী হয় তা নিয়ে এখন থেকেই আলোচনা শুরু হয়েছে। তার আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে ভারত সফরে যাচ্ছেন। এ সময় তিনি দিল্লিতে দ্বিপক্ষীয় জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকে অংশ নেবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে সামনে রেখে মোমেনের এ সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জেসিসি বৈঠক আগামী ১৮ জুন অনুষ্ঠিত হতে পারে। দুই বছর পর এ বৈঠক হতে যাচ্ছে। এতে দুই দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি, নদীর পানি বণ্টন, বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা অংশীদারত্বসহ বেশ কিছু ইস্যুতে আলোচনা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App