×

মুক্তচিন্তা

ছাত্র আন্দোলন নাকি সন্ত্রাস উৎপাদন?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২২, ০১:২৮ এএম

ছাত্র আন্দোলন নাকি সন্ত্রাস উৎপাদন?

কিছুদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এককালের গৌরব পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনসহ অতীতের তাবৎ আন্দোলনে ইতিহাসখ্যাত ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আজ আর সেই ভূমিকায় নেই। এটিই হলো বেদনাদায়ক সত্য। আরো মারাত্মক সত্য হলো- এই সংগঠন কয়েকটি বছর ধরে সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনকে যেভাবে পেশিশক্তির মাধ্যমে দখল করে রেখে সুস্থধারার ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষার আধুনিকীকরণ আন্দোলন, দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের ও প্রগতির ধারায় ফিরিয়ে আনার আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে- তার পরিণতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে শুভ হবে না- দেশের জন্য তো নয়ই। দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃত্ব ও ছাত্রলীগের বর্তমান সন্ত্রাসী এবং দখলদারিত্বের ভূমিকাকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সমর্থন দিয়ে চলেছেন যারা তারা সম্ভবত ভাবছেন, তাদের মদতে ছাত্রলীগের চলমান ভূমিকা শিক্ষাঙ্গনসহ দেশের সব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিরোধী শক্তিগুলোকে দুর্বল করে দেবে এবং তার ফলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথ সুগম হবে। এখন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিদ্যমান সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু পেছন ফিরে দেখা যাক- সম্প্রতি হঠাৎ করেই ছাত্রলীগ এমন সন্ত্রাসী ভূমিকায় লিপ্ত হলো কেন? এ সম্পর্কে কম-বেশি আমাদের গণমাধ্যমগুলো বিগত কয়েক দিন ধরেই উল্লেখ করে চলেছে যে, সদ্য সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা দলটির জাতীয় সম্মেলন ত্বরান্বিত এবং সফল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার আগেই আওয়ামী লীগের তাবৎ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে তাদের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। পদ হারানোর ভয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে কোনো কৌশলে তাদের জাতীয় সম্মেলন পিছিয়ে দেয়ার বা স্থগিত ঘোষণার পরিস্থিতি কৃত্রিমভাবে তৈরি করতেই এমন সন্ত্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত এমন খবরের কোনো প্রতিবাদ জানাননি ছাত্রলীগ নেতারা- তাই ওই খবর সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়। ছাত্রলীগ আরো একটি সুযোগ পেয়ে যায় বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি উক্তিকে বিএনপি নেতৃত্ব ‘অত্যন্ত অবমাননাকর’ বলে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রীকে ওই উক্তি প্রত্যাহার করার দাবিতে আন্দোলন এবং একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে এই সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঢাকাসহ নানা স্থানে যে সভা-সমাবেশ ঘোষণা করেছে- তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ওই দুটি দাবিতে আন্দোলন ও সমাবেশের আয়োজন করায় ছাত্রলীগ নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সুনজরে আসার লক্ষ্যে ছাত্রদলের মিছিল-সমাবেশের ওপর হামলা চালায়। ছাত্রদলও সুযোগ পেয়ে তাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য ছাত্রলীগের মিছিলের উপর পাল্টা আঘাতে ক্যাম্পাস পরিস্থিতি ভয়াবহভাবে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ছাত্রদলের এই ভূমিকাকে নানা উক্তির মাধ্যমে বিএনপির মূল নেতারা আরো বেশি উসকে দিতে এ কথা পর্যন্ত বলেছেন যে, বেশি দিন লাগবে না- ছাত্রদলই এই সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই বড় দল বলে পরিচিত। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী ঐতিহ্য বহুদিনের। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের মতো অসংখ্য দিকপাল তো দীর্ঘকাল দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন, জনগণের স্বার্থে অসংখ্য আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, মুসলিম লীগ ও সামরিক শাসকদের বিস্তর অত্যাচার-নির্যাতন ও কারাজীবন হাসিমুখে দেশের স্বার্থে ভোগ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ওই সব আন্দোলনের ছিল প্রাণশক্তি। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কখনো মিলিতভাবে, কখনো পৃথকভাবে ছাত্র ও জনতার স্বার্থে দেশে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারই ফসল হলো আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেদিনকার সেই আন্দোলনগুলোতে ছাত্রাবস্থায় তো আমি নিজেও আরো অনেকের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছি, সেই আন্দোলন সংগ্রামই দেশকে বহু জননেতা উপহার দিয়েছে- যারা দেশ পরিচালনা করেছেন অসীম যোগ্যতার সঙ্গে। যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে যারা হত্যা করেছিল তারা কি পেছনে হাঁটতে, পাকিস্তান অভিমুখী করে তুলতে, প্রগতির সব ধারা মুছে ফেলার প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়েছিল? সে ধারার আজো অবসান ঘটেনি বরং প্রতিক্রিয়ার সেই ধারা জিয়া-এরশাদ প্রবর্তিত অন্ধকারের ধারা দিনে দিনে ফুলে-ফলে বিকশিত হচ্ছে আজো। ছাত্র আন্দোলন সেদিন সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকায় ছিল। ষাটের দশকে সামরিক সরকার এনএসএফ নামে যে সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠনের জন্ম দিয়েছিল ছাত্র নেতাদেরকে সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত করে ছাত্র আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে, সেই সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাদের ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন এবং শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার হলগুলো থেকে তাড়িয়ে শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করেছিল। সে ইতিহাস গৌরবের এবং গর্বের। সেদিনকার ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ ও এককভাবে আন্দোলন করেছে সব স্তরের শিক্ষাদান বাংলাভাষায় করার জন্য, জাতীয় জীবনের সব স্তরে বাংলার প্রচলনের জন্য, একমুখী ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলনের জন্য। কিন্তু আজ দেখা যায় ভাষা আন্দোলন তো বহুদিন আগের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলেও শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা ফেরানো হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল প্রমুখ অসাম্প্রদায়িক ও খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখকদের রচনা সংবলিত পাঠ্যপুস্তকের প্রচলন করতে, এককেন্দ্রিকের পরিবর্তে ত্রিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ বাংলা মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে কিন্ডারগার্টেন এবং আরবি মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ঘটিয়ে সেদিনকার দাবিকে ভূলুণ্ঠিত করে প্রতিক্রিয়ার শক্তি বৃদ্ধি করছে। ধনীর ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে, মধ্য ও নিম্নবিত্তরা বাংলা মাধ্যমের মূলধারার স্কুল, কলেজে এবং দরিদ্র ঘরের সন্তানরা আরবি মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করছে যার পরিণামে ধনীর সন্তানরা দামিদামি চাকরি ও বিদেশে নানা ক্ষেত্রে স্থান পাচ্ছে, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা শেষে একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে- মাদ্রাসায় আরবি মাধ্যমে শিক্ষা নিয়ে সেই শিক্ষার্থীরা বেকারত্বে ভুগছে- বড়জোর মাদ্রাসা-মক্তবে শিক্ষকতা, মসজিদের ইমাম প্রভৃতি নিম্ন বেতনের কাজে নিযুক্ত হয়ে কষ্টের জীবন অতিবাহিত করছে। কিন্তু এই বৈষম্য দূর হতে পারে একমাত্র এককেন্দ্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে। অথচ তা আজ পরিত্যক্ত। এতে লাভবান হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো। জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে শুধু তাই নয়- তারা দুটি বড় দলে অনুপ্রবেশ করে সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। এতে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। একদিকে দুটি বড় দলে ভয়াবহ কোন্দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের মারাত্মক সন্ত্রাস- অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতি দেশকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখন তো ছাত্র সংগঠনগুলোর সামনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের ইস্যু হলো দ্রব্যমূল্য কমানো- তার ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধের দাবিতে আন্দোলন। কিন্তু ছাত্র সংগঠন দুটি তো তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থান নিয়ে অন্তঃকলহে ভয়াবহভাবে নিমগ্ন। সাধারণ ছাত্রসমাজ এই পরিস্থিতি কখনোই কামনা করে না। তারা চায় ক্যাম্পাসে শান্তি বিরাজ করুক, সন্ত্রাস বন্ধ হোক, শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসুক। তারা তেমন শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি তো দেখছেই না- উল্টো দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে পর্যন্ত বিস্তর ক্ষতি করেছে। আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, বিচারপতিদের নিরাপত্তা পর্যন্ত বিঘিœত হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল দুটি এই পরিস্থিতি থামানোর উদ্যোগ না নিয়ে পরস্পর দোষারোপের চিরন্তন পথে বাজার গরম করে চলেছে- রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত ও কলুষিত হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবেই ক্ষতি হচ্ছে দেশের, জনগণের, রাজনীতির এবং গণতন্ত্রেরও। কারণ এহেন পরিস্থিতিতে জনগণ হয়ে পড়েন দলবিমুখ এবং সামগ্রিকভাবেই রাজনীতিবিমুখ। তা হয়ে পড়ছেনও। আর এই পরিস্থিতিতে সুযোগ নিতে পারে অরাজনৈতিক অন্ধকারের শক্তিগুলো। আমাদের ছাত্রসমাজকেও ভাবতে বলি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে চিরঞ্জীব করে রাখতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App